ঘাটে ঘাটে দুর্নীতি by সারোয়ার সুমন

ভিন্ন তিনটি মডেলে চীন থেকে ৬০০ রেফ্রিজারেটর এনেছে একটি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দরের 'ও' শেডে সেগুলো রেখে খালাসের জন্য কাস্টমসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেন আমদানিকারক। নিয়ম অনুযায়ী আমদানি করা এসব রেফ্রিজারেটরের 'লোডিং ক্যাপাসিটি' মেপে শুল্কহার নির্ধারণ করবে কাস্টমসের জেটি শাখা; কিন্তু রেফ্রিজারেটর মাপতে গিয়ে 'কুলিং ক্যাপাসিটি' মেপে নেন সংশ্লিষ্ট শাখার অ্যাপ্রেইজার। এতে ঘোষিত মাপের সঙ্গে তৈরি হয় ভিন্নতা। শুল্কহারও বেড়ে যায় কয়েক লাখ টাকা। বিষয়টি আমদানি শাখার ডেপুটি কমিশনারকে তাৎক্ষণিক জানান আমদানিকারক; কিন্তু তিনি অ্যাপ্রেইজারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পিএর মাধ্যমে দেন বিকল্প প্রস্তাব। ঝামেলা এড়াতে শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে ৮০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে রেফ্রিজারেটর ছাড়িয়ে আনেন আমদানিকারক!

ঘুষের এ চিত্র বিস্তৃত চট্টগ্রামের সব সেবা প্রতিষ্ঠানেই। জমির খতিয়ান নম্বর ঠিক করতে গেলে ঘুষ দিতে হয় ভূমি অফিসে। একইভাবে ভবনের নকশা অনুমোদন করতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে, পেনশনের টাকা আনতে ট্রেজারি অফিসে, বিদ্যুতের লাইন টানতে পিডিবিতে, পানির লাইন বসাতে চট্টগ্রাম ওয়াসায় ঘুষ দিতে হয়। আবার বিদেশ থেকে পছন্দের পণ্য আনতে ঘুষ দিতে হয় চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে। আমদানি করা পণ্য তাড়াতাড়ি খালাস করতে হলে ঘুষ লাগে চট্টগ্রাম বন্দরে।
দুদক কেন নীরব : বাণিজ্য নগরীর প্রতিটি সেবা প্রতিষ্ঠানে ঘুষখোররা এভাবে হাট খুলে বসলেও নীরব দর্শক দুর্নীতি দমন কমিশন। আইনি জটিলতার কারণে ফাঁদ পেতে এখন আর ঘুষখোর ধরতে যায় না তারা। চলতি বছর এখন পর্যন্ত কোনো সেবা প্রতিষ্ঠানেই হাতেনাতে ঘুষখোর ধরতে যায়নি দুদক। কারণ ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি দুদক চট্টগ্রাম অফিসেরই উপ-পরিচালক এসএম সাবি্বর হাসানকে ঘুষের ১০ লাখ টাকাসহ হাতেনাতে ধরেছে র‌্যাব। এ ঘটনার কারণে চট্টগ্রামে ইমেজ সংকটে ভুগছে দুদক।
বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম দুদকের বিভাগীয় পরিচালক মেজর ফয়সাল পাশা বলেন, হাতেনাতে ঘুষখোর ধরার ঘটনা সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে; কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষী, সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়া এবং বাদীকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে না পারায় ফাঁদ পেতে ঘুষখোর ধরতে পারছি না আমরা। দুদকের উপ-পরিচালককে র‌্যাব ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করার ঘটনা দুদকের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করেছে কি-না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এ ঘটনা দুদকের কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তবে দুদকের আর কোনো কর্মকর্তা যাতে এ পথে পা না বাড়ান সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে দুদক। সাবি্বরের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করতে আদালতে এরই মধ্যে
শক্ত ভূমিকা নিয়েছে দুদক।
এদিকে দুদকের এমন নিষ্ক্রিয়তায় বাড়ছে ঘুষ-দুর্নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক রিপোর্টও বলছে, দেশে দুর্নীতি কমেনি এতটুকু। চট্টগ্রামের বিভিন্ন সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে সরেজমিন গিয়েও এ কথার সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, সেবা নিতে যাওয়া সাধারণ মানুষকে ঘুষের জন্য কীভাবে হয়রানি করা হচ্ছে।
যেভাবে পাতা হয় ঘুষের ফাঁদ : চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসে ঘুষ দিতে হয় ধাপে ধাপে। কাস্টমসে বিল অব এন্ট্রি দাখিলের পরপরই ঘুষের জন্য পকেটে হাত রাখতে হয় আমদানিকারক, রফতানিকারক কিংবা তাদের মনোনীত প্রতিনিধি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে। আমদানি পর্যায়ে ১৩ ধাপে ও রফতানি প্রক্রিয়ায় ১২ ধাপে ঘুষ দিতে হয় কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। ঘুষের টাকা নিতে অনেকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে 'ফালতু' নামে কিছু কর্মচারীকে। লোকবল কম থাকার সুযোগে কোনো বেতন ছাড়াই তারা কাজ করছে কাস্টমসে। ঘুষ বখশিশের টাকা দিয়েই মাস পার করে তারা। কাস্টমসের ১৩টি শুল্ক শাখায় এমন 'ফালতু'র সংখ্যা প্রায় অর্ধশত!
প্যাভিলিয়নে যাওয়া আমদানি ডকুমেন্ট শুল্কায়ন শাখায় নিতে ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় ক্লার্ককে। শুল্কহার দ্রুত নির্ধারণ করতে বখশিশ দিতে হয় প্রিন্সিপাল অ্যাপ্রেইজার ও অ্যাপ্রেইজারকে। পণ্যের মানভেদে এক্ষেত্রে বখশিশের রেট হয় ৩০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। শুল্কহার নির্ধারণের পর ডকুমেন্ট পাঠানো হয় প্যাভিলিয়নে। এতে যোগসূত্র স্থাপনকারী ক্লার্ককে দিতে হয় ৩০ থেকে ৫০ টাকা। কায়িক পরীক্ষার নির্দেশনা থাকলে জেটিতে ডকুমেন্ট নিতে বাড়তি গুনতে হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। এ পরীক্ষায় কোনো ভুল বা অনিয়ম ধরা পড়লে পণ্যভেদে ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় বলে জানান সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা। রফতানি চালানের ক্ষেত্রেও ঘুষ-বখশিশের প্রক্রিয়া প্রায় অভিন্ন। তবে বন্ড কিংবা রফতানিযোগ্য কাঁচামালের পণ্য হলে ঘুষের বাড়তি রেট ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। রফতানি পণ্যের কয়েকটি বেসরকারি আইসিডিতে থাকায় সেখানে পরীক্ষার জন্য অ্যাপ্রেইজারকে নিতে গাড়ি ভাড়াসহ বাড়তি বখশিশ গুনতে হয় বলে জানান সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা।
ভূমি অফিসেও ঘুষ দিতে হয় ধাপে ধাপে। জমির নামজারি করতে হলে ঘুষ দিতে হয় আটটি ধাপে। এসব ধাপ অতিক্রম করতে ঘুষ দিতে হয় ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আবার নতুন ভবনের নকশা অনুমোদন করতে হলে ঘুষ দিতে হয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশন অফিসে। কারণ পুরনো ভবন ভাঙা, নতুন ভবনের জন্য মাটি পরীক্ষা ও করপোরেশনের অনাপত্তি পত্র নিতে এ তিনটি অফিসে যেতে হয় আবেদনকারীকে। আবার পেনশন কিংবা বকেয়া বেতন তুলতে হলে যেতে হয় থানা শিক্ষা অফিস, জেলা শিক্ষা অফিস ও ট্রেজারি শাখায়। এ তিনটি অফিসে ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে পেনশনের টাকা ওঠাচ্ছেন বলে সমকালকে জানান পাহাড়তলী থানার শিক্ষক আবদুর রহিম।

No comments

Powered by Blogger.