প্রসঙ্গঃ স্পিকারের 'যমতন্ত্র' by জয়নাল আবেদীন

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ মাঝে মধ্যেই খুবই সত্য কথা_ এমনকি অপ্রিয় সত্য কথাও বক্তৃতায় বলে থাকেন। সংসদের ভিতরে ও বাইরে সত্য ভাষণের জন্য তিনি অনেকের কাছে খুবই প্রিয়। তিনি আমারও একজন প্রিয় ব্যক্তি। তাকে ভালো লাগে তার সৃষ্ট ভাষণের জন্য। তার সর্বশেষ সৃষ্ট ভাষণ পড়লাম গত শুক্রবার (৩০.০৯.২০১১) দৈনিক সংবাদ-এর শেষের পাতায় 'লুটেরা ধনীদের জন্যে যমতন্ত্র আসছে' শিরোনামে প্রকাশিত রিপোর্টে।

সংবাদ-এর কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি প্রেরিত ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে কিশোরগঞ্জ শহর সমবায় সমিতির শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে স্পিকার আবদুল হামিদ বলেছেন 'যেভাবে একটি শ্রেণী দুর্নীতিতে লিপ্ত রয়েছে, একের পর এক বহুতল ভবনের মালিক হচ্ছে, সমাজতন্ত্র না হোক, আগামী ১০ বছর পর ঢাকা শহরে লুটেরা ধনীদের জন্য 'যমতন্ত্র' আসবে। রাজধানীর নিঃস্ব মানুষেরা লুটেরাদের বাড়িঘর দখল করবে_ ভাড়াটিয়ারা ভাড়া আটকে দেবে। গরিব মানুষেরা রাস্তায় নামলে সেনাপ্রধান ও পুলিশপ্রধানরাও রক্ষা করতে পারবেন না।' স্পিকারের আশা পূর্ণ হোক এ কামনা করি। আগামী ১০ বছর পরে ঢাকাসহ সারাদেশে 'যমতন্ত্র' এসে লুটেরা ধনিক শ্রেণীকে নাস্তানাবুদ করুক। এটা কায়মনোবাক্যে চাই।
আসলেই স্পিকারের মূল্যায়ন যথার্থ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ঢাকায় ফিরেই মুজিবনগর সরকারপ্রধান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন 'আমরা সবাই দুঃখ ভাগ করে নিব।' এ কথাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন এভাবে 'আমি বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই।' কিন্তু দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির যে দুঃখ ভাগ করে নেয়ার ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন নিয়ে ভাবনার দুই মহান নেতাকেই লুটেরা ধনিক শ্রেণীর ভাড়াটিয়া খুনিদের হাতে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।
পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো থেকে বের হয়ে 'বাংলাদেশ' রাষ্ট্র নির্মাণের উদ্দেশ্যই ছিল শোষণমুক্ত, বঞ্চনামুক্ত দেশ গড়া। কিন্তু ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্ট ও ৩ নভেম্বরে যথাক্রমে ৩২নং ধানমন্ডিতে ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনদের হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে শোষণ ও বঞ্চনা যুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু তার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বুর্জোয়া বহু দলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে সমাজতান্ত্রিক একদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির জন্য গঠন করেছিলেন 'বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ' সংক্ষেপে 'বাকশাল'। এ ব্যবস্থা সফল হলে বাংলাদেশে লুটেরা ধনিক শ্রেণী বিলুপ্ত হয়ে অভাবমুক্ত, সমবণ্টন ও সুষম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম হতো। কিন্তু শোষণ, বঞ্চনামুক্ত সমাজ হলে লুটেরা ধনিকদের লুটপাট চলতো না। তাই এই লুটেরা_ধনিকরা মিলিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে দিল। দুঃখ হয় বঙ্গবন্ধু যাদের জন্য পদক্ষেপ নিয়ে অকালে স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয়-স্বজনসহ প্রাণ বিসর্জন দিলেন_ সেই গরিব-দুঃখী মানুষদের 'বাকশাল' কর্মসূচি ও বঙ্গবন্ধুর শেষ চিন্তা-ভাবনার কথা বুঝানো হচ্ছে না। বুঝানো হচ্ছে না কিভাবে দেশে কয়েক হাজার 'শত কোটি পতির' সংখ্যা হলো। কিভাবে দেশের সিংহভাগ সম্পদের মালিক এই নব্য কোটিপতিদের কব্জাগত হলো।
আজকে স্পিকার যাদের লুটপাটের কথা বলে ১০ বছর পরে 'যমতন্ত্র' আসার কথা বলছেন, এই লুটেরা ধনিক শ্রেণী কারা? তারা তো বড় রাজনৈতিক প্রধান দু'দলের কা-ারি। ১৯৭৫ সালের পরে ব্যবসার নামে, চাকরির নামে, নীতিজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে যারা লুটপাট করেছেন, তারাই আজ প্রধান দু'টি-তিনটি দলের মুখ্য নিয়ন্ত্রক। তারা দু'দলে বিভক্ত হয়ে সামনে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রেখেছেন শুধু সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে পক্ষে এনে, ভোটের বৈতরণী পার হওয়ার জন্য। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল যদি প্রকৃতই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ করে তা হলে তো বঞ্চনা ও শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন অর্থনীতি তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলত। কিন্তু বাস্তবে তো আমরা অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে তেমন কিছু দেখছি না। কারণ লুটপাটকারীরাতো বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা কখনো চাইবে না। তাই ক্ষমতাসীন দলীয় স্পিকার হয়তো আক্ষেপ করে 'যমতন্ত্রের' কথা বলেছেন। কিন্তু তার কল্পিত 'যমতন্ত্র' আসার তো কোন লক্ষণ দেখছি না।
[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা।]

No comments

Powered by Blogger.