হাইকোর্টের নকল শাখায় ঘুষবাণিজ্য by ওয়াকিল আহমেদ হিরন

হাইকোর্টের নকল শাখায় চলছে জমজমাট ঘুষবাণিজ্য। অতিরিক্ত টাকা ছাড়া একটি নকলও মেলে না। চাহিদামতো টাকা না দিলে দিনের পর দিন ঘুরেও নকল মেলে না। এতে ভোগান্তিতে পড়েন বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ব্যবসায়ী রতন খান খাসজমি পত্তন বিষয়ে গত বছরের জানুয়ারিতে হাইকোর্টে রিট মামলা করেন। রায় তার পক্ষে গেলে নকল তুলতে আইনজীবী ২০ হাজার টাকা চান। টাকা না দেওয়ায় যথাসময়ে নকল তুলতে পারেননি রতন। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিয়ে ডিসেম্বরে নকল সংগ্রহ করেন তিনি।

এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সলিমুল্লাহর ভাই গত মাসের শেষ দিকে হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। আদেশের কপি দ্রুত কারাগারে পাঠাতে তার আইনজীবীর মুহুরি ৫ হাজার টাকা চান। এক সপ্তাহ ঘুরে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে নকল তোলেন সলিমুল্লাহ।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের আইনজীবী এবিএম বায়েজীদ জানান, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির একটি রিট মামলার অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ (ভ্যাকেট) প্রত্যাহার সংক্রান্ত নকলের কপি তুলতে রিট সেকশনে মে মাসে আবেদন করেন তিনি। সে সময় তাকে জানানো হয়, মামলার নথি সই হয়ে সেকশনে যায়নি। পরে নকল ওঠানোর জন্য ১০ জুলাই আবেদন (পিসি নম্বর-১১৯৭৩) করা হয়। নকল শাখার লোকজন জানান, নথিটি পাওয়া যায়নি। ১৮ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতির কাছেও আবেদন করা হয়। আজও নকলের কপি পাননি বায়েজীদ।
সরকারি হিসাব : রিট, ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার নকল সংগ্রহের জন্য উচ্চ আদালতে তিনটি শাখা রয়েছে। জরুরি (সাতদিন) নকলের সরকারি ফি ১০ টাকা ও কোর্ট ফি ১০ টাকা। প্রথম পাতার জন্য ১০ টাকা, পরবর্তী কোর্ট ফোলিও ২ টাকা, প্রতি পাতায় ২ টাকার স্ট্যাম্প লাগাতে হয়। ১০ পাতার নকলের সরকারি খরচ ৫৮ টাকা। সাধারণ খরচ ১৬ টাকা। সাধারণ জাবেদা নকলের জন্য দরখাস্ত, দুটি ফোলিও এবং কোর্ট ফি বাবদ খরচ ৮ টাকা, চারটি ফোলিও দিয়ে নকল ওঠাতে ১৮ এবং ছয়টি ফোলিও দিয়ে নকল ওঠাতে খরচ ২৬ টাকা নির্ধারিত। তবে এ হিসাব কেবল কাগজে-কলমে।
আদালতের চিত্র : সুপ্রিম কোর্ট ভবনের নিচতলায় রিট সেকশন থেকে মামলার নকল
সরবরাহ করা হয়। নকল তোলার কথা বললে এক কর্মচারী এ প্রতিবেদককে জানান, অফিস সময়ের পর অথবা সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে আসুন। তিনি খরচ নিয়েও আসতে বলেন। নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত অর্থ সেকশনের সুপারিনটেন্ডেন্ট, অফিস সহকারী, পিয়ন ও নকল সরবরাহকারী ভাগ করে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক আইনজীবী বলেন, ওটা নকল শাখা নয়, বাণিজ্য শাখা।
প্রতিটি নকল বাবদ সর্বনিম্ন ২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অতিরিক্ত ফি না দিলে কেউ নকল ওঠাতে পারেন না। অন্যথায় দীর্ঘ ভোগান্তি পোহাতে হয়।
সংশ্লিষ্ট শাখার এক কর্মচারী সমকালকে জানান, মামলার জামিন আদেশের কপি পরদিনই সংশ্লিষ্ট কারাগারে পাঠানোর দায়িত্ব সেকশনের; কিন্তু মক্কেল সরাসরি না এসে মুহুরির মাধ্যমে অর্থ দিয়ে আদেশের কপি দ্রুত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সে ক্ষেত্রে সেকশনের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সামান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন।
নকল শাখার উৎকোচের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের ৩ নম্বর ডেপুটি রেজিস্ট্রার সাবি্বর ফয়েজ সমকালকে বলেন, নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। আবেদনকারীরা যথাসময়ে নকল পেয়ে থাকেন। নকল সরবরাহের জন্য সরকার নির্ধারিত ফির পরিমাণ আদালতের দেয়ালে টানানো রয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।
আবেদন : উচ্চ আদালতে ফৌজদারি শাখায় নকলের ১ হাজার ৬০০ আবেদন জমা পড়েছে। গত মাসে সরবরাহ করা হয়েছে ১ হাজার ১০০টি। দেওয়ানি রিভিশন শাখায় ১ হাজারের বেশি আবেদনের বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে আট শতাধিক। রিট শাখায় প্রায় ১ হাজার ৭০০ আবেদনের বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ৯০০টির বেশি। বেশ ক'টি বেঞ্চে ২০০৬ সালের রায়ের কপি এখনও সই হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.