হঠাৎই আমি ‘কালারড’! যেন ভয়ঙ্কর এক প্রাণী by সুমনা সিনহা

প্যারিসে আছি প্রায় ১৫ বছর৷ আইফেল টাওয়ারের গায়ে এই অ্যাভেনিউ পল দ্যুমেরে রয়েছি প্রায় এক বছর৷ দেড় দশকের এই অভিবাসী জীবনে যে অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি, সেই ঘটনার মুখোমুখী হলাম আজ৷ চেনা এই শহর হঠাত্ অচেনা হয়ে গেল৷ প্রকাশ্যে চলে এল 'আমরা-ওরা' বিভাজন৷ জানি না এই ঘটনার রেশ কাটতে কতদিন লাগবে আমার৷ প্যারিসের মহল্লাগুলিকে সার্কেল বলে৷ আমি থাকি ১৬ নম্বর সার্কেলে৷ মোটামুটি উচ্চবিত্তদের পাড়া৷ তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, এই এলাকা মূলত শ্বেতাঙ্গ ফরাসিদের পাড়া৷ এখানে অভিবাসী খুব একটা নেই, ভারতীয় অভিবাসী তো গত এক বছরের একটিও দেখিনি৷ আমার পাড়ায় ছোট্ট একটি সুপার মার্কেট রয়েছে যেখানে কিছু শ্রীলঙ্কার তামিল কাজ করে৷ কিছু ফিলিপাইন রয়েছে যারা উচ্চবিত্ত বাড়িগুলিতে পরিচারকের কাজ করে৷ আর আছে একদল পর্তুগিজ৷ যারা বড় বাড়িগুলিতে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করে৷ এই হলো ১৬ নম্বর সার্কেলের জনবিন্যাস৷ খাঁটি শ্বেতাঙ্গ ফরাসিদের পাড়া হলেও এই এক বছরের কোনো অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা আমার হয়নি৷ গতকাল দু'জায়গায় পণবন্দিদের নিয়ে টানাপোড়েন শেষ হওয়ায় এবং জঙ্গিরা নিহত হওয়ায় আপাতদৃষ্টিতে ফ্রান্সে মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে৷ যার ব্যতিক্রম আমিও নই৷ উইকএন্ড হওয়ায় একটু দেরিতে প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েছিলাম বাজার করতে৷ অ্যাভেনিউ পল দ্যুমেরে একটি ছোট্ট সুপার মার্কেট থাকলেও মাছ-মাংস কেনার জন্য পাশের পাড়া র্য দ্য পাসি'তে যাই৷ এটাসেটা ভাবতে ভাবতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটছি৷ আমার বাড়ি থেকে দেড়-দু'শো মিটার দূরে একটি ফুলের দোকান আছে৷ সেই দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাত্ নারীকণ্ঠের আর্ত চিত্কার শুনে আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম৷ যেন প্রবল ভয় পেয়ে কয়েকজন চিৎকার করছে৷ তাকিয়ে দেখি দোকানের কাছে সোনালি চুলের তিনটি ফরাসি মেয়ে আমাকে বড় বড় চোখ করে দেখছে৷ চিৎকার করছে৷ পরনে ওভারকোট ও জিনস৷ প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আমার পিছনে বোধহয় কেউ আছে৷ যাকে দেখে এরা ভয় পেয়েছে৷ কিন্তু পিছনে কেউ নেই দেখে বুঝতে পারলাম আমাকে দেখে এরা চিৎকার করছে৷ যেন আমি ভয়ঙ্কর কোনো প্রাণী৷ তার পর মেয়ে তিনটি যা করল আমি কল্পনাও করতে পারিনি৷ ওরা চিৎকার করে ফুল দোকানের পাশে গলি দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল৷ প্রাথমিক বিহ্ললতা কাটিয়ে আমি ওই গলিতে ঢুকে জোরে বললাম, 'তোমরা কেন চিৎকার করছ?' মেয়ে তিনটি ফের চিৎকার করতে করতে একটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল৷ এই অভিজ্ঞতায় কখনও হয়নি আমার৷ কোনো রকমে ধাতস্থ হয়ে ফের বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে উপলব্ধি করলাম এই আচরণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ গত পাঁচ দিনে পালটে গিয়েছে ফ্রান্স৷ পালটে গিয়েছে প্যারিসের খাঁটি ফরাসিরা৷ নিশ্চই সকলে নয়, আবার অনেকেই৷ শার্লি এবদোয় জঙ্গি হানা এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহর প্রতিক্রিয়ায় শ্বেতাঙ্গ ফরাসিদের একাংশ কেমন যেন ঘৃণা ও সন্দেহের চোখে দেখছে অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের৷ বিশেষ করে আমাদের মতো যারা 'কালারড', তাদের প্রতি গোঁড়া ফরাসিদের সন্দেহ বহুগুণ বেড়েছে এই কয়েক দিনে৷ এই অ্যাভেনিউ পল দ্যুমেরে যে ফরাসিরা থাকে তাদের সিংহভাগ আবার দক্ষিণপন্থী৷ তারা উপেক্ষা করছে৷ ফরাসিরা যদি কাউকে ঘৃণা করে, অবিশ্বাস করে তা হলে তার সঙ্গে দ্যুর্ববহার করে না৷ স্রেফ মুখ ঘুরিয়ে নেয়৷ বুঝিয়ে দেয় যাকে সে ঘৃণা করছে, তার অস্তিত্বকে তারা অস্বীকার করছে৷ আমরা আজকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাই মেলাতে পারলাম গত মেট্রোতে স্ত্রাসবুর্গ স্যাঁ দনি জাংশনের কিছু টুকরো টুকরো ছবি৷ প্যারিসে মেট্রোর শাখাপ্রশাখা জালের মতো ছড়িয়ে আছে৷ এক একটি রুটকে নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়৷ মেট্রোতে বোমাতঙ্ক হওয়ায় কাল সন্ধ্যায় চার নম্বর লাইনে মেট্রো চলাচল বন্ধ ছিল৷ তাই ৫ নম্বর লাইনের মেট্রোতে উঠে দেখি দুই আলজিরীয় দাঁড়িয়ে৷ তাদের শশ্রুগুম্ফ দেখে বোঝা যায় তারা একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের৷ নিজেদের মধ্যে তারা কথা বলছিলেন৷ যেই আমি কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি আমাকে দেখেই চোখ নিচু করে সেই যে তারা কথা বন্ধ করলেন আমি মেট্রো থেকে নেমে যাওয়া পর্যন্ত আর কোনো কথা বলেননি৷ মেট্রোতে দেখছি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারও দিকে তাকালে তারা চোখ নামিয়ে নিচ্ছেন৷ তাদের চোখ মুখে অদ্ভুত ভয়৷ শ্বেতাঙ্গ ফরাসিরা এদের দিকে প্রায় তাকাচ্ছেই না৷ বা তাকালে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে৷ বোঝাই যাচ্ছে অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের অবিশ্বাসের চোখে দেখছে ফরাসিরা৷ মূল সন্দেহ নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের দিকে৷ আমি মেয়ে তাই চট করে কোন সম্প্রদায়ের তা বোঝা যায় না৷ কিন্তু 'কালারড' তো, তাই শ্বেতাঙ্গদের কাছে আমিও অবিশ্বাসের পাত্র৷ উপেক্ষার বিষয়৷ ভয়ঙ্কর এক প্রাণী৷ দিনের শেষে তাই বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না কোন কারণে মেয়ে তিনটি আমাকে দেখে চিৎকার করে দৌড় দিল৷ সুমনা সিনহা: প্যারিস প্রবাসী

No comments

Powered by Blogger.