রাজনৈতিক দলের চিন্তাচেতনায় নারসিসিজমের বৈশিষ্ট্য by মো. আবদুল মুহিত

প্রাচীন গ্রিসে নারসিসাস নামে একজন সুদর্শন সাহসী বীর রাজপুত্র ছিল। একদা বনে শিকার শেষে সে একটি ঝরনার ধারে বিশ্রাম করছিল। বিশ্রামরত অবস্থায় সে অদ্ভুত কিছু শব্দ শুনতে পেল। শূন্যের মাঝে যে নারী কণ্ঠ ভেসে আসছিল তা ছিল ইকো নামের এক অপরূপ রূপসী রমণীর। কিন্তু মুশকিল হল, তার প্রতিটি উচ্চারিত বাক্য পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। এর পেছনে কাহিনী হল, সে তাদের দেবতা জিউসের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। ফলে জিউসের স্ত্রী হেরা তাকে অভিশাপ দেয় যে তার মুখে সব সময় আগের বলা কথার পুনরাবৃত্তি হবে। এ অভিশাপের ফলে ইকো সমাজ থেকে দূরে পাহাড়, বনজঙ্গলে নির্বাসিত হয়। মানুষের ব্যঙ্গবিদ্রুপের কারণে ইকো সুন্দরী দেবী আফ্রোদিতির কাছে প্রার্থনা করে যে তাকে যেন অদৃশ্য করে রাখা হয়। যাহোক নারসিসাস যখন ঝরনার ধারে বিশ্রাম করছিল, ইকো তার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে চারদিকে প্রশংসার বাণী ছড়িয়ে দেয়। নারসিসাস শূন্যে ভেসে আসা স্তুতিমূলক বাক্য শুনতে শুনতে পাশে থাকা পানিতে তার শরীরের প্রতিফলিত রূপ দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। সে নিজের অবয়বে এতটাই মুগ্ধ, বিভোর হয়ে যায় যে, ইকোর প্রণয় আহ্বান তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। সে অপলক দৃষ্টিতে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং একসময় গভীর পানিতে তলিয়ে যায়। পরে সেখানে পদ্মফুল গাছের জন্ম হয়। তাই মনোবিজ্ঞানে মানব চরিত্রের এ বৈশিষ্ট্যকে Narcissism নামে আখ্যায়িত করা হয়। যার অর্থ হল আপন মোহে মুগ্ধ ও অপরের প্রতি সহমর্মিতার অভাব থাকা। অনেকটা স্বার্থপরের কাছাকাছি। এ চরিত্রের মানুষরা একান্ত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। অপরের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন করে না। অন্যের মতামতের কোনো মূল্যায়ন করে না। শুধু তার প্রশংসাকারীদের সে অসম্ভব আপনজন ভেবে থাকে। এরা নিজেদের কর্মকাণ্ডে নিজেরাই অভিভূত হয়ে থাকে, অপরের অর্জনগুলোকে খাটো করার সর্বাত্মক প্রয়াস চালায়। নিজেদের কাজের বিন্দুমাত্র সমালোচনা সহ্য করতে পারে না, এমনকি তার কাজের প্রশংসা না করলে সেসব ব্যক্তির প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণ প্রকাশ করে থাকে। এরা নিজেদের সব কাজের কাজি ভাবতে শুরু করে।
বাঙালির রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্রকে বিশ্লেষণের জন্য এর চেয়ে ভালো উপমা খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রতিটি সরকার এবং রাজনৈতিক দল চারিত্রিক এবং ভাবগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে Narcissism-এর শিকার। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মোটামুটিভাবে ১৯৯০ সাল থেকে গণতান্ত্রিকভাবে গঠিত সরকার দেশ পরিচালনা করে আসছে। প্রতিটি সরকারের সফলতা বা ব্যর্থতা পর্যালোচনা করেই এদেশের জনগণ প্রতিটি নির্বাচনে তাদের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন করার সুযোগ পেয়েছে। এভাবে প্রধান দুটি দল পালাক্রমে সরকারও গঠন করেছে। প্রতিটি সরকারি দল তাদের আমলে দেশের উন্নয়নের ফিরিস্তি সংসদে উপস্থাপন করলে বিরোধী দল হত্যা-লুটপাট-সন্ত্রাস-মানবাধিকার হরণ ইত্যাদির তালিকা নিয়ে হাজির হয়েছে। প্রতিটি সরকার তাদের সময় দেশ অত্যন্ত সুচারুরূপে পরিচালিত হয়েছে বলে অত্যুক্তি প্রকাশ করে থাকলে বিরোধী দল আন্দোলন করে সাধারণের জীবনযাপন অসহনীয় করে তুলেছে। এসবের মাঝে গরিব জনসাধারণের ভাগ্যের প্রকৃত উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে তা বিবেচনার দাবি রাখে। তথাপি এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাই দেশের আর্থ-সামাজিক কিঞ্চিৎ উন্নয়নের পেছনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
৫ জানুয়ারি আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল সেই শিশু গণতন্ত্রকে হত্যা বা রক্ষার নামে আন্দোলন কিংবা উৎসবে নেমে পড়েছে। এ অবস্থায় আবারও সাধারণ নাগরিকদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এরই মধ্যে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনে মনে হবে তাদের আমলে দেশ স্বর্গের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আর অন্যদিকে বিরোধী দলের বক্তব্য, দেশ নরকে রয়েছে। এটা সরকারের নারসিসাসের মতো আচরণ। অপরদিকে বিরোধী দলও ইকোর মতো বারংবার একই কথা পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। অনেকটা ভাঙা ক্যাসেট প্লেয়ারে একই গান বারবার শোনা। তবে এবারে বিরোধী দলের অন্যতম দাবি হল সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, মধ্যবর্তী সংসদ নির্বাচন। আর এ বিষয়েও সরকার তার আগের অবস্থানে অনড়। অর্থাৎ একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের কোনো ধরনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে বিরোধী দলও হরতাল-অবরোধ দিয়ে সাধারণের জীবন বিপন্ন করে তুলছে। এর পেছনে দুই দলের নেতাদের সেই নারসিসিজমই ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে জনসাধারণ হল খুব ভালো মনোবিজ্ঞানী। তারা রাজনৈতিক নেতাদের এ মানসিক বৈকল্যের যোগ্য প্রতিদান দেন ভোটের মাধ্যমে। তাই তো কোনো সরকার তাদের কৃত উন্নয়নের গালগল্প মেরেও একবারের বেশি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তারা ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়ছে বারবার।
তবে এবারের সরকার শুধু যে Narcissism-এর শিকার ছিল তাই নয়, এদের চরিত্রে Machiavellianism-এর বৈশিষ্ট্যও বিদ্যমান। এটা এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যেখানে মানুষ আবেগবর্জিত এবং প্রচলিত নৈতিকতাবিমুখ হয়ে পড়ে। এ বৈশিষ্ট্যের লোকজন নিজেকে সমাজ থেকে আলাদা ভাবতে শুরু করে। এরা প্রতারণা এবং ছলচাতুরির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সমূহ ক্ষতিসাধন করে থাকে। দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে বর্তমান সরকার প্রায় নিশ্চিত ছিল যে তারা জিততে পারবে না। কারণ গত বছর ওই নির্বাচনের প্রাক্কালে যে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়েছিল, সেখানে ক্ষমতাসীন সরকারের ভরাডুবি তাদের ভাবিয়ে তুলেছিল। ফলে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা একটি প্রহসনের নির্বাচন করেছিল। যেখানে প্রায় অর্ধেকের বেশি আসনে কোনো ব্যক্তিকে ভোট কেন্দ্রে যেতে হয়নি। এটি স্পষ্ট জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। যদিও ওই নির্বাচন সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ ছিল, কিন্তু জনগণের মতামত সেখানে প্রতিফলিত হয়নি। তাই সে সময়ে সরকার এ নির্বাচনকে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন নামে আখ্যায়িত করেছিল। অতঃপর সরকার গঠন করে তারা বেমালুম ভুলে গেছে সেই প্রতিশ্র“তি। এখানেও তাদের Machiavellianism-এর বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। প্রতারণা, ছলচাতুরি দিয়ে গঠিত এই সরকার আগামী পাঁচ বছর দেশ শাসন করলেও অবাক হওয়ার কিছুই নেই। আমাদের দেশে এটি সম্ভব।
মো. আবদুল মুহিত : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বর্তমানে জাপানে গবেষণারত

No comments

Powered by Blogger.