এক কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকারের বিদায়

‘ওরা ১১ জন’ দিয়ে শুরু। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বারবার ফিরে এসেছে তার চলচ্চিত্রে। তবে বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম আর ফিরবেন না। চলচ্চিত্র অঙ্গন আর প্রিয় মানুষদের শোকাচ্ছন্ন করে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। গতকাল ভোরে ইন্তিকাল করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এ চলচ্চিত্র নির্মাতার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত এ খ্যাতিমান রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বেশ কিছুদিন ধরেই এ হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল চাষী নজরুল ইসলামের। গত বুধবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে সাধারণ কেবিন থেকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়া হয়। গত বছরের মে মাস থেকে চিকিৎসক প্রফেসর ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ আকরাম হোসেনের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনি। গত কয়েকদিন ধরেই তার অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। শেষদিকে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। শনিবার সকাল ১০টার দিকে হঠাৎ রক্তচাপ মারাত্মকভাবে কমে যায়। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতেও খুব কষ্ট হচ্ছিল। এ অবস্থায় কৃত্রিমভাবেই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর সব বন্ধন ছিন্ন করে গতকাল ভোরে চিরবিদায় নিলেন তিনি। তার মৃত্যু সংবাদে পুরো চলচ্চিত্র শিল্পে শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকেই ল্যাব এইড হাসপাতালে ছুটে যান তাকে শ্রদ্ধা জানাতে। হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ রাজধানীর কমলাপুরের জসীমউদ্‌দীন রোডস্থ বাসায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেও অসংখ্য গুণগ্রাহী ভিড় করেন। বাদ জোহর তার এলাকায় দু’বার জানাজা শেষে মরদেহ আবার নিয়ে যাওয়া হয় ল্যাব এইড হাসপাতালে। সেখানে হিমঘরে রাখা হয়েছে মরদেহ। চাষী নজরুল ইসলামের দুই মেয়ের একজনের স্বামী ম্যানিলায় থাকেন। তিনি ফিরলে আজ বিকালে মুন্সীগঞ্জের পারিবারিক কবরস্থানে মা শায়েস্তা খানমের কবরে এই চলচ্চিত্র পরিচালককে সমাহিত করা হবে। এর আগে সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত এফডিসি ও ১১টা থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। উল্লেখ্য, চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৪১ সালের ২৩শে অক্টোবর মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার সমষপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালে টাটানগরে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে প্রথম অভিনয় করেন প্রখ্যাত এই নির্মাতা। ১৯৬০ সালে ফতেহ লোহানীর সঙ্গে ‘আসিয়া’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর কাজ করেন ওবায়েদ উল হকসহ আরও অনেকের সঙ্গে। অভিনয়ও করেন কিছু ছবিতে। ১৯৭২ সালে পরিচালনা করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম পূর্ণাঙ্গ ছবি ‘ওরা ১১ জন’। ছবিটি ব্যাপক প্রশংসিত হয়। তার পরিচালিত উল্লেখযোগ্য অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘সংগ্রাম’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘ভাল মানুষ’, ‘দাঙ্গা-ফ্যাসাদ’, ‘বাসনা’,‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘দেবদাস’, ‘লেডি স্মাগলার’, ‘হাছন রাজা’, ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘ধ্রুবতারা’, ‘রঙিন দেবদাস’, ‘শুভদা’, ‘শিল্পী’, ‘শাস্তি’, ‘সুভা’, ‘শহীদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন’ ইত্যাদি।
প্রেসিডেন্টের শোক
প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবদুল হামিদ বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। গতকাল এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, তার মৃত্যুতে দেশের চলচ্চিত্র জগৎ একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হারালো। তিনি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও জীবনধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ করে দেশবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রীর শোক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ও নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। গতকাল শোকবার্তায় তিনি বলেন, চাষী নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও জীবনধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ করে দেশবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তার মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো। শেখ হাসিনা মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
খালেদা জিয়ার শোক
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গতকাল এক শোকবার্তায় বেগম জিয়া বলেন, একজন গুণী ও মেধাসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার হিসেবে চাষী নজরুল ইসলাম অনেক কৃতিত্ব ও সুনাম অর্জন করেছিলেন। এ জন্য তিনি জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কীর্তিমান এ পরিচালকের মৃত্যুতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে যে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে, তাতে আমিও গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত। তার মৃত্যুতে দেশের চলচ্চিত্র জগতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। বিএনপি চেয়ারপারসন চাষী নজরুল ইসলামের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকাহত পরিবারের সদস্য, ভক্ত, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি সমবেদনা জানান।
স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের শোক
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামের মৃত্যুতে সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও  ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোকবাণীতে স্পিকার বলেন, চলচ্চিত্র জগতে চাষী নজরুল ইসলাম একজন কিংবদন্তি পরিচালক ছিলেন। তার সুনিপুণ নির্মাণশৈলী বাঙালির মনকে আকৃষ্ট করতো অনায়াসে। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র একজন দক্ষ পরিচালক ও আদর্শ ব্যক্তিকে হারালো। স্পিকার মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। ডেপুটি স্পিকার বলেন, চাষী নজরুল ইসলাম সময়ের সাহসী সন্তান। তার নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এছাড়া, চিফ হুইপ আ.স.ম ফিরোজও শোক প্রকাশ করেছেন।
সংস্কৃতিমন্ত্রীর শোক
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোক বার্তায় সংস্কৃতিমন্ত্রী মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
তথ্যমন্ত্রীর শোক
চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’-এর নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে তার অনবদ্য ভূমিকার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও একুশে পদকপ্রাপ্ত চাষী নজরুল ইসলামের কাজের স্বীকৃতি শুধু পুরস্কারেই সীমাবদ্ধ নয়, তা কোটি মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উদ্দীপ্ত করার মধ্যেও নিহিত। হাসানুল হক ইনু এ সময় প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালকের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘সংগ্রাম’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’র পাশাপাশি সামাজিক ছবি ‘ভাল মানুষ’, ‘শুভদা’ ও ‘বেহুলা লক্ষ্মীন্দর’-এর কথাও স্মরণ করেন। তিনি চাষী নজরুল ইসলামের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে শোকসন্তুপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
তথ্য সচিবের শোক
চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মরতুজা আহমদ। শোকবার্তায় তিনি বলেন, তার মৃত্যুতে দেশ একজন অনন্য চলচ্চিত্র প্রতিভাকে হারালো। মুক্তিযুদ্ধ, সমাজ ও ঐতিহ্যের ওপর নির্মিত তার চলচ্চিত্রগুলো আগামীতেও আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.