আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত তুরাগতীর by ইকবাল আহমদ সরকার ও এম এ হায়দার সরকার

দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি এবং মুসলিম উম্মাহর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি, সংহতি, অগ্রগতি আর দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণ কামনা করে আমিন! আমিন!! ধ্বনির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ তাবলীগ জামাত আয়োজিত ৫০তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। প্রায় আধঘণ্টা ধরে এ মোনাজাত পরিচালনা করেন তাবলীগ জামাতের দিল্লি মারকাজের শূরা সদস্য, ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা সা’দ। আখেরি মোনাজাতকালে গোটা ইজতেমা ময়দান এলাকা যেন এক পুণ্যময় ভূমিতে পরিণত হয়। টঙ্গীর তুরাগতীরে অনুষ্ঠিত বহু কাঙ্ক্ষিত এই আখেরি মোনাজাতে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে রহমত ও হেদায়েত প্রার্থনা করেছেন। নিজ নিজ গুনাহ মাফ ও আত্মশুদ্ধি চেয়েছেন। এ সময় মহান আল্লাহপাকের অশেষ মহিমায় আবেগ-আপ্লুত লাখো মুসল্লির কণ্ঠে উচ্চারিত ‘আমিন! আমিন!!’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে তুরাগতীর। অশ্রুসিক্ত নয়নে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণে ব্যাকুল হয়ে পড়েন অনেক মুসল্লি। লাখ লাখ মুসল্লির সঙ্গে ইজতেমা ময়দান এলাকায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, গাজীপুর জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলাম, পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি সফিকুল ইসলাম, গাজীপুর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের কূটনৈতিক মিশনের সদস্য ও পদস্থ সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তারাসহ লাখ লাখ মুসল্লির সঙ্গে মোনাজাতে অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বজনদের নিয়ে গণভবনে ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে মোনাজাতে অংশ নেন। এর আগে ফজরের নামাজের পরই শুরু হয় শেষদিনের বয়ান। বহু কাঙ্ক্ষিত আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে শীতের তীব্রতা উপেক্ষা করে দূরদূরান্তের মুসল্লিরা দলে দলে ইজতেমা প্রাঙ্গণে আসতে থাকেন ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধের ভোগান্তি আর নানা দুর্ভোগ উপেক্ষা করে। টুপিপরা মুসল্লির স্রোত অব্যাহত থাকে আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত। আখেরি মোনাজাত ঘিরে সমগ্র ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এক পুণ্যময় পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। আখেরি মোনাজাতকে ঘিরে যাতে কেউ কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা আর নাশকতা যাতে না ঘটাতে পারে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয় গোটা ইজতেমা এলাকা। মোনাজাতের দিন অন্যান্য দিনের চেয়ে নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়। ট্রাফিক ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়। তবে ইজতেমার পর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে টঙ্গী অংশে যানজট লেগে যায়। ভোর থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে টঙ্গী ব্রিজ থেকে ভোগড়া বাইপাস, টঙ্গী স্টেশন রোড থেকে মীরেরবাজার পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ করা হয়। র‌্যাব-পুলিশ পোশাকি ডিউটির বাইরেও সাদা পোশাকে কাজ করে প্যান্ডেলের ভেতর ও বাইরে। ফজরের নামাজের পর থেকে ইজতেমা ময়দানে তাবলীগ জামাতের মুরব্বিরা সুবিশাল চটের প্যান্ডেলের নিচে অবস্থানরত দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশে তাবলীগের ছয় উসুল কালিমা, নামাজ, ইলম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, সহি নিয়ত এবং তাবলীগ- এসব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেন। বয়ানে বলেন, প্রতিটি মুসলমানের উচিত দ্বীনের মেহনত খেদমত করা, দ্বীনের জন্য মেহনত চালু হয়ে গেলেই দুনিয়া ও আখিরাতে শানিমশ আসবে। যারা দ্বীনের মেহনতের জন্য তাবলীগের কাজে নিয়োজিত হবেন আল্লাহ তাআলা পরকালে তাদেরও শান্তির পুরস্কার দেবেন। আখেরি মোনাজাতের আগে কয়েক ঘণ্টা ধরে এসব বিষয়ের বয়ান ছাড়াও চলে হেদায়েতি বয়ান।
প্রথম পর্বে যারা বয়ান করেন: গতকাল ইজতেমার প্রথম পর্বের শেষদিনে বাদ ফজর থেকেই তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি দিল্লির হজরত মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ বয়ান করেন। তার বয়নের বাংলায় অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলাম। দ্বিতীয় দিন শনিবার ফজরের নামাজের পর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইসমাইল হোসেন গোদরা, জোহরের পর ভারতের হজরত মাওলানা শওকত আলী, আসরের পর ভারতের হজরত মাওলানা মোহাম্মদ জোয়াহের, মাগরিবের পর পাকিস্তানের মাওলানা আবদুল হক। শুক্রবার ফজরের নামাজের পর পাকিস্তানের মাওলানা মো. এহসানের আম বয়ানের মাধ্যমে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়। বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মো. আবদুল মতিন। ওইদিন ভারতের মাওলানা শওকত এবং আসরের পর বাংলাদেশের ঢাকার কাকরাইল মসজিদের হাফেজ মোহাম্মদ জোবায়ের বয়েন করেন। আর মাগরিবের নামাজের পর থেকে বয়ান করেন দিল্লির মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ। আখেরি মোনাজাত পরিচালনাকারী মাওলানা সা’দ মোনাজাতের আগের বয়ানে ইমান ও আমলের ওপর বিভিন্ন হেদায়েতি বয়ানে বলেন, দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতের প্রতি আমাদের বেশি করে খেয়াল রাখতে হবে। দুনিয়ার জিন্দিগির চেয়ে আখিরাতের জিন্দিগি হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী। আমাদের ওপর বৃষ্টির ফোঁটার মতো পেরেশানি ধেয়ে আসছে। এ পেরেশানি থেকে রক্ষার জন্য আমাদের ইমানি শক্তিকে আরও মজবুত করতে হবে। ধাবিত হতে হবে আখিরাতের দীর্ঘ জিন্দিগির দিকে। আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে নিজের কৃতকর্মের অনুসূচনার মাধ্যমে তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। চোখের পানি ফেলে মোনাজাত করতে হবে। মোনাজাত কবুল হলেই আমরা পাপমুক্ত হবো। দুনিয়া ও আখিরাতে ফিরে আসবে শান্তি।
১০ সহস্রাধিক বিদেশী মেহমান: এবারের ইজতেমার প্রথম পর্বে আশপাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ সৌদি আবর, বাহরাইন, কুয়েত- এসব মুসলিম দেশের ধর্মপ্রাণ তাবলীগ জামাতের মুসল্লিরা তো এসেছেনই, এছাড়া এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ মোট ৯০টি দেশ থেকে তাবলীগ জামাতের প্রায় ১০ হাজার বিদেশী মেহমান অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক বিদেশী মেহমান আগমন করেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাবলীগের কাজে চিল্লায় বের হওয়ার জন্য এবার ইজতেমাস্থলে কয়েক হাজার জামাত তৈরি হয়েছে বলে ইজতেমার আয়োজক সূত্রে জানা গেছে।
আরও ৪ মুসল্লির মৃত্যু: বিশ্ব ইজতেমায় আরও ৪ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ইজতেমার প্রথম পর্বে নয়জন মারা গেছেন। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার হরিচাঁদপুর গ্রামে আবদুস সোবাহান (৬৫) নামে এক মুসল্লির মৃত্যু হয়। শনিবার দিবাগত রাতে মারা যান তিন মুসল্লি। তাদের মধ্যে রাত সোয়া ১১টায় চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার বুলারধারী এলাকার মকবুল হোসেন (৭৫), শনিবার রাত ১২টায় শ্বাসকষ্টে ভুগে সিলেটের জকিগঞ্জ থানার কাদিরপুর এলাকার সাদেকুর রহমান (২০) এবং রাত ১টায় চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা থানার সুবলপুর এলাকার তোয়াজ্জেল হোসেন (৫০)। এর আগে দুই দিনে মারা গেছেন ইজতেমার আরও ৫ জন।
মহিলাদের ভোগান্তি: বিশ্ব ইজতেমা মাঠে মহিলাদের জন্য কোন ধরনের সুবিধা না থাকলেও আখেরি মোনাজাতে শামিল হতে এসেছেন হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মহিলা। মহিলাদের জন্য কোন ধরনের আয়োজন ছিল না ইজতেমা মাঠে। তবু দূরদূরান্ত থেকে দলে দলে এসেছেন আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত। নদীর পাড়ে, খোলা আকাশের নিচে, বাসাবাড়ির ছাদে এমনকি সড়কের পাশে খোলা জায়গায় ঠাঁই নিয়ে মোনাজাতে শরিক হয়েছেন তারা। আসা-যাওয়ার পথে জনপুরুষদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কির বিড়ম্বনায় পড়েন তারা।
বাড়ি ফেরায় দুর্ভোগ: আখেরি মোনাজাত শেষে লাখো মুসল্লি তাদের নিজস্ব গন্তব্যে ফিরে যেতে যানবাহন সঙ্কটে পড়ে দুর্ভোগের শিকার হন। ২০ দলের ডাকে টানা অবরোধে অনেক যানবাহন চলাচল করলেও সড়কের চেহারা স্বাভাবিক না থাকায় দুর্ভোগ চরমে ওঠে। এরই মধ্যে আবার লেগে যায় দীর্ঘ যানজট। মোনাজাত শেষে লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমা ময়দান থেকে চারদিকের সব সড়কে স্রোতের মতো একসঙ্গে ফিরতে শুরু করলে কয়েক কিলোমিটার এলাকা মানবসমুদ্রে পরিণত নয়। বাড়ি ফেরার স্রোতে অনেকে কোন যানবাহন না পেয়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেন।
দ্বিগুণ মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস: ইজতেমা ময়দান এলাকার অস্থায়ী মার্কেটগুলোতে দ্বিগুণ মূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি হতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ৪০ টাকা হালির ডিম বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। অধিকাংশ কাঁচা তরকারি বিক্রি হচ্ছে চড়া দমে। পাশাপাশি শীতবস্ত্র বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ মূল্যে। বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কোন উদ্যোগই কাজে লাগছে না। অতিরিক্ত মূল্যে জিনিসপত্র বিক্রির ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা জানান, ইজতেমা উপলক্ষে জায়গার ভাড়া অত্যধিক বেশি হওয়ায় তাদের বাধ্য হয়েই বেশি মূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি করতে হচ্ছে। এবার বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হওয়ার পর মাঝে ৪ দিন বিরতি দিয়ে ১৬ই জানুয়ারি ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে ১৮ই জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে এবারের দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি ঘটবে। দিন দিন ইজতেমায় মুসল্লির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থান সংকুলানের অভাবে ও মুসল্লিদের যাতায়াতে যানবাহন চলাচলে চাপ কমাতে গত ২০১১ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা টঙ্গীর তুরাগতীরে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এমনকি এ বছর ইজতেমা তুরাগের পশ্চিমতীরেও সমপ্রসারণ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.