কয়েস লোদীকে রুখে দিলেন বিদ্রোহীরা by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ

মন্ত্রণালয়ের চিঠি হাতে পেয়েও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়রের চেয়ারে বসতে পারলেন না রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। তাকে রুখে দিলেন বিদ্রোহীরা। সিটি করপোরেশন আইন, মন্ত্রণালয়ের আদেশ কিছুই মানেননি তারা। কয়েস লোদীকে রুখতে হাতাহাতিতে জড়াতেও দ্বিধা করেননি। অথচ কয়েস লোদী তাদের ভোটেই মেয়র প্যানেলের প্রথম সদস্য। তারাই ঠিক করে দিয়েছিলেন মেয়র না থাকলে সবার আগে ভার নেয়ার সুযোগ পাবেন কয়েস লোদী। তবে যখন সময় এসেছে কয়েস লোদীকে তারা সুযোগ দিতে নারাজ। গত শনিবার রাত থেকেই টের পাওয়া গিয়েছিল কিছু একটা হতে চলেছে নগরভবনে। কানাকানি, ফিসফাঁস, প্রস্তুতি-থমথমে করে তুলছিল পরিস্থিতিকে। রক্তপাত হবে, তবু মেয়রের চেয়ার পাবেন না কয়েস লোদী-কান পেতে এমনও শোনা গেছে। কয়েস লোদীকে ঠেকাতে বড় ধরনের প্রস্তুতি যে ছিলো তা টের পাওয়া যায় রাত পোহাতেই। নগরভবনের আশপাশে আনাগোনা বাড়ে চেনা-অচেনা মুখের। সেই মুখগুলোতে যেকোন মূল্যে কয়েস লোদীকে রুখে দেয়ার অঙ্গীকার। এই মুখগুলো আগেও রুখে দেয়ার অনেক মিশন সফল করেছে, হাত দিয়ে- অস্ত্র দিয়ে। আতঙ্ক ছড়ায় আশেপাশে। সতর্ক হয় পুলিশ। কড়া নজরদারি রাখে নগরভবনে। সকাল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নগরভবনে একে একে জড়ো হতে শুরু করেন কয়েস লোদীর প্রতিপক্ষ কাউন্সিলররা। মেয়রের চেয়ারজুড়ে বসেন মেয়র প্যানেলের দ্বিতীয় সদস্য অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদ। তাকে মনোনীত করে গিয়েছিলেন নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। যিনি মন্ত্রণালয়ের আদেশে পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত। সে ‘বরখাস্ত’ মেয়রের আদেশকে শিরোধার্য করে সালেহ আহমদ আমলেই নেননি মন্ত্রণালয়ের আদেশকে। তাকে বেপরোয়া হতে ভরসা যোগান কিছু অনুসারী কাউন্সিলর। এর মধ্যে কৌশল নির্ধারণের দায়িত্ব নেন কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমদ। প্রতিবাদী ভাষা, ব্যানার সবকিছুরই নেপথ্যে থাকেন তিনি। আর শক্তির যোগানদাতা হিসেবে সালেহ আহমদের পাশে থাকেন কাউন্সিলর ফরহাদ চৌধুরী শামীম। তাদের ভরসা-সাহসে রোববার যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব আসে নগর ভবনে। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসেন কয়েস লোদীও। বিশাল বহর নিয়ে তিনি নগর ভবনে প্রবেশ করতে চান। পুলিশ বাধা দেয় কয়েক শ’ গজ আগেই। জনাদশেক বর্ষীয়ান প্রতিনিধি নিয়ে কয়েস লোদী প্রবেশ করেন নগর ভবনে। ঢুকেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে। সেখানে আগে থেকেই বসা ছিলেন ফরহাদ চৌধুরী শামীম। বাধা দেন কয়েস লোদীকে, কথা কাটাকাটি হয়। শামীম হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে কয়েস লোদীর সমর্থক কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমানের সঙ্গে। কক্ষে থাকা অন্য কাউন্সিলররা নিবৃত করেন দুই ‘যোদ্ধা’কে। উত্তেজনা কিছুতেই না থামায় সকাল ১১টায় রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা। দুই ঘণ্টা বৈঠকে আপস হয়। তবে শেষ হয়ে যেনো শেষ হতে চায় না উত্তেজনা। বৈঠকে কি সিদ্ধান্ত হয় তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। দুই পক্ষই নিজের নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেন সিদ্ধান্তের। কয়েস লোদীর বক্তব্য, সমস্যার সমাধান হয়েছে। সিটি করপোরেশন বিধি মোতাবেক চলবে। তিনিই মেয়রের চেয়ারে বসতে পারবেন এমনটাই আশাবাদ তার। আর প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের প্রতিনিধি কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমেদও বৈঠকের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট। তবে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন কয়েস লোদী চেয়ারে বসতে পারবেন না। তিনি বলেন, সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে সালেহ আহমদ দায়িত্ব পালন করে যাবেন যতক্ষণ না পর্যন্ত মেয়র আরিফের কাছ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসে। তবে কি মন্ত্রণালয়ের আদেশের কোনই মূল্য নেই-এমন প্রশ্নে রেজওয়ানের জবাব সিটি করপোরেশনের নিজস্ব বিধি-বিধান আছে। সে বিধানের ১২ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, বহিষ্কার হলেও ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব প্রদানের এখতিয়ার কেবলই নির্বাচিত মেয়রের।
তবে সিটি করপোরেশন আইনের যে ১২ ধারাকে আঁকড়ে আছেন বিদ্রোহী কাউন্সিলররা সে ধারাটি কিন্তু তাদের পক্ষে কথা বলছে না। ১২ (২) এর উপধারা-১ এ বলা হয়েছে ‘সিটি করপোরেশনের কোন মেয়রকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের আদেশ প্রদান করা হইলে উক্ত আদেশপ্রাপ্তির তিন দিনের মধ্যে সাময়িকভাবে বরখাস্তকৃত মেয়র, তাহার দায়িত্ব পালনকারী জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে মেয়রের প্যানেলের সদস্যের নিকট স্বীয় দায়িত্ব হস্তান্তর করিবেন।’ সে হিসেবে কয়েস লোদীরই মেয়রের চেয়ারে বসার কথা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশনে সরকারের প্রতিনিধি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ভূমিকাও স্পষ্ট নয় বলে সুর উঠেছে। অনেকেই বলছেন তিনি চাইলেই সমস্যার সহজ সমাধান দিতে পারতেন। এব্যাপারে মানবজমিনের সঙ্গে কথা হয় সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবিবের সঙ্গে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের বিধি বিধানের বাইরে যাওয়ার এখতিয়ার কারো নেই। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী কারাগারে আটক থাকায় তার দ্বারা মেয়রের ক্ষমতা প্রয়োগ জনস্বার্থের পরিপন্থি বলে মন্ত্রণালয়ের আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় নির্বাচিত মেয়র মহোদয়ের নতুন করে নির্দেশনা দেয়ার কোন সুযোগ নেই।
প্রসঙ্গত, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে নির্বাচিত মেয়র কারান্তরীণ আরিফুল হক চৌধুরীকে বরখাস্ত করে গত বুধবার প্যানেল মেয়র প্যানেলের প্রথম সদস্য রেজাউল হাসান কয়েস লোদীকে মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য চিঠি প্রদান করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কিন্তু কয়েস লোদীকে শুরু থেকেই মানতে নারাজ করপোরেশনের কিছু কাউন্সিলর।

No comments

Powered by Blogger.