দিনভর অবরুদ্ধ গুলশান-বনানী

গতকাল প্রায় অবরুদ্ধ ছিলেন অভিজাত গুলশান-বনানী এলাকার বাসিন্দারা। দুপুরের আগ থেকেই ওই এলাকায় প্রবেশের সবপথে কড়া নিরাপত্তা বসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইজতেমা শেষে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীরা ঢাকায় অবস্থান নেবে সরকারের এমন আশঙ্কা ছিল বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। এমন আশঙ্কা থেকেই গতকাল রাজধানীর এ অভিজাত এলাকায় এমন কড়াকড়ি আরোপ করা হয় বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানালেও সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে স্পষ্ট কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গতকাল সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ওই এলাকায় সাধারণ মানুষের চলাচলে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ব্যক্তিগত কিংবা পাবলিক যান ঢুকতে দেয়া হয়নি। এমনকি পরিচয়পত্র ছাড়া অপরিচিত কোন ব্যক্তিকে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি পুলিশ। ব্যক্তিগত কিংবা অফিসিয়াল কাজে গিয়েও পড়েন বিপাকে। এতে দিনভর অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহান ওই এলাকার বাসিন্দারা। পুলিশের এমন কড়াকড়িতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো গুলশান-বনানী এলাকায়। বেশির ভাগ বিপণিবিতান, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। এদিকে বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। কার্যালয়ের সামনের রাস্তার দুদিকে ফের ৭টি ট্রাক এনে রাখা হয়। মোতায়েন করা হয় দুই প্লাটুন দাঙ্গা পুলিশ। সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সকালেই গুলশান এলাকার প্রবেশপথ বনানীর কাকলী সিগন্যাল, চেয়ারম্যানবাড়ি, মহাখালীর আমতলী, গুলশান-১ এর শুটিং ক্লাব, গুলশান-বাড্ডার লিংকরোড,  আমেরিকান এ্যাম্বাসি পয়েন্ট, নর্দ্দা, বারিধারার সবগুলো পয়েন্টে কাঁটাতারের ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয় পুলিশ। প্রতিটি পয়েন্টে মোতায়েন করা হয় দাঙ্গা পুলিশ। বন্ধ করে দেয়া হয় সব ধরনের যান চলাচল। অল্প কিছু গাড়ি ওই এলাকা থেকে বের হলেও কোন গাড়ি ঢুকতে দেয়া হয়নি। বনানী-গুলশান-২-বাড্ডা রোড দিয়ে চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজি অটোরিকশা, হিউম্যান হলারসহ সব ধরনের পাবলিক যান উল্টোপথে ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। অপরিচিত কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। জরুরি কাজে ওই এলাকায় যাওয়া মানুষরা চরম বিপাকে পড়েন। অনেককে পরিচয়পত্র দেখানোর পরও প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়নি। পূর্বঘোষণা ছাড়াই পুলিশের এমন অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাধারণ মানুষ। সাংবাদিক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাওয়া অনেকে পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলেও দীর্ঘপথ  হেঁটে গন্তব্যস্থলে যেতে হয়েছে।  বেলা ১২টার দিকে গুলশান-২ নম্বরে যাওয়ার উদ্দেশে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসে উঠেন গৃহবধূ আসমা বেগম। গাড়িটি কাকলী সিগন্যালে আসার পর পুলিশ ঘুরিয়ে দেয়। এসময় যাত্রীদের নামিয়ে দেন বাসচালক। এতে দুধের শিশু কোলে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন ওই গৃহবধূ। পুলিশের কাছে কাকুতি-মিনতি করার পরও তাকে ঢোকার অনুমতি দেয়নি। অসহায় ওই গৃহবধূ প্রবেশ করতে না পেরে ফিরে যান।  বেলা সাড়ে ১২টার দিকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের উদ্দেশে সিএনজি অটোরিকশাযোগে রওনা হন ইংরেজি দৈনিক নিউএজের এক সংবাদ কর্মী। তাকে বহনকারী অটোরিকশাটি  গুলশান-১ নম্বরের শুটিং ক্লাবের পয়েন্টে আসামাত্রই পুলিশ আটকে দেয়। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর তাকে প্রবেশের অনুমতি দিলেও সিএনজিটিকে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। পরে বাধ্য হয়ে এই দীর্ঘপথ হেঁটে গুলশান বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে আসেন তিনি। এভাবে ওই এলাকায় দিয়ে চলাচলকারী হাজারো মানুষ দিনভর চরম দুর্ভোগ পোহান। এমন কড়াকড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে কর্তব্যরত এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থেই এমন কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। এদিকে পুলিশের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে অংশ নেয়া শেষে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীরা অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার কার্যালয়মুখী হতে পরেন। তাই বিরোধী নেতাকর্মীরা যাতে ওই এলাকায় যেতে না পারেন সেজন এমন কড়াকড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এদিকে গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় নবম দিন পার করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গতকাল সকাল দিকে কার্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের মতো থাকলেও দুপুরের দিকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। কার্যালয়ের সামনের রাস্তার পুলিশের তল্লাশি চৌকির উত্তরদিকে ৩টি ও দক্ষিণদিকে ৩টি ইট-বালু ও সিমেন্ট ভর্তি ট্রাক এনে রাখা হয়। কার্যালয়ে দুদিকে একশ’ গজের মধ্যে মোতায়েন করা হয় দুই প্লাটুন দাঙ্গা পুলিশ। এছাড়া একটি জলকামান ও দুটি পুলিশ ভ্যান আড়াআড়িভাবে রাখা আছে। কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে লাঠি হাতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন একদল নারী পুলিশ। প্রধান ফটকের তালা খোলা থাকলেও পুলিশের অনুমতি ছাড়া কাউকে ওই কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।  ৮৬ নম্বর ওই সড়ক দিয়ে সাধারণ মানুষ ও যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এদিকে বেলা সোয়া ১১টায় কার্যালয়ের দোতলায় দলের মহিলা নেত্রীদের সঙ্গে বিশ্ব ইজতেমার প্রথমপর্বের আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন খালেদা জিয়া। বেলা ১২টার দিকে সাবেক এমপি হেলেন জেরিন খান, শাম্মী আখতার, শওকত আরা উর্মি, মাসুদা মির্জা, শাহিনুর আখতার সাগর, সুলতানা রাজিয়া খাবার নিয়ে কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। ঘণ্টাখানেক  কার্যালয়ে অবস্থানের পর তারা বেরিয়ে আসেন। ওদিকে ৯ দিনের মাথায় অবরুদ্ধ খালেদা জিয়াকে দেখতে যান দলের স্থায়ী কমিটির তিন বর্ষীয়ান সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও  ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে আলাদাভাবে তারা কার্যালয়ে প্রবেশ করেন।  ঘণ্টাখানেক পর কার্যালয় থেকে বেরিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। অবরোধ কতদিন চলবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সকল দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। আমরা বারবার সরকারকে আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু সরকার তা নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে। তবুও আমরা অপেক্ষায় আছি- সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। তারা আলোচনার উদ্যোগ নেবে। অন্যথায় আন্দোলন চলবে।
বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ কি আদৌ ফোন করে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার খোঁজ নিয়েছেন কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অমিত শাহর সঙ্গে নেত্রীর কথা হয়েছে। খালেদা জিয়া যেভাবে আছেন সেটাকে কি গৃহবন্দি বলা যায়, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে রফিকুল বলেন, এটা গৃহবন্দি নয়, তিনি  বন্দি রয়েছেন। এছাড়া  খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন বলেও জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য। এদিকে রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান তা উপদেষ্টা ও আইনজীবী  এজে মোহাম্মদ আলী।
উল্লেখ্য, ৩রা জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টায় গুলশান কার্যালয়ে আসেন খালেদা জিয়া। এরপর থেকেই কার্যালয়ের সামনে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলে পুলিশ। ওইদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমন খবর পেয়ে রিজভী আহমেদকে দেখতে যাওয়ার জন্য গুলশান কার্যালয় থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নেন তিনি। এসময় বিএনপি চেয়ারপারসনের পথরোধ করে পুলিশ। প্রায় আধাঘণ্টা গাড়িতে বসে থেকে ফের কার্যালয়ে ঢুকে পড়েন তিনি। পূর্ব ঘোষিত ৫ই জানুয়ারির সমাবেশে যাওয়া ঠেকাতে কার্যালয়ের সামনের রাস্তার দুইপাশে এনে রাখা হয় ১১টি ইট ও বালুভর্তি ট্রাক। এরপর থেকেই কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনবারের এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ৫ই জানুয়ারি বেলা ১২টার দিকে কার্যালয়ের তিনটি ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয় পুলিশ। ওইদিন বিকালে কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে খালেদা জিয়ার গাড়ি লক্ষ্য করে পেপার সেপ্র নিক্ষেপ করা হয়। পুলিশি বাধা পেয়ে গেটেই দাঁড়িয়েই সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা তিনি। পরদিন বালুর ট্রাক সরানো হলেও ব্যারিকেড সরানো হয়নি। এরপর থেকে নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ জীবন কাটাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

No comments

Powered by Blogger.