ডিসেম্বর ও জানুয়ারির টেক্সচুয়াল শোক by জয়া ফারহানা

হেরাক্লিটাসকে তার শিষ্য প্রশ্ন করলেন, ‘মহাশয়, আপনি কাহার পক্ষে? যুদ্ধের না শান্তির?’ হেরাক্লিটাসের উত্তর, ‘আমি শান্তির পক্ষে। কারণ শান্তির সময় পুত্র পিতার কবর খনন করিয়া থাকে, আর যুদ্ধের সময় পিতা পুত্রের।’ এখনকার সময়টা দেখুন। পিতা পুত্রকে কবর দেয় না, তাকে লুকিয়ে রাখে! তো এমন জায়গায় যে, অন্যরা তাকে জুস খাওয়াতে পারে। আমাদের সবারই কি আসলে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে। তা না হলে প্রতিপক্ষকে আটকাতে ইট-বালুর ট্রাক পাঠাবো কেন? এক যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায়ের পরে শিবির কর্মীরা যেসব ট্রাক ও গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল, সেগুলো পাঠালেও তো বোঝা যেত নার্ভাস সিস্টেমটা ঠিক আছে। টেলিভিশনের পর্দায় লোকে একটা চিত্র পেত।
জিহাদ মারা গেল। তা এ রকম অপঘাতে মৃত্যুর মহামারী তো আমাদের দেশে আছেই। ট্রেনের কামরা আর ট্যুরিস্ট স্পটের আলাপের মতো দু’দিন পরেই যথারীতি এসব মৃত্যুর কথা আমরা ভুলেও যাই। পথে পড়ে থাকা আইসক্রিমের ঠোঙা বা ছেঁড়া কাগজের দিকে আমরা যেমন আর ফিরে চাই না, এসব মৃত্যুও তেমন থাকে অলক্ষেই। দু’দিন হইচই। ঘটমান বর্তমানে সবাই অনিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী, বিপ্লবী। তারপর আবার নীরবতা, যতক্ষণ না আরেক জিহাদ গর্তে পড়ে। ফর্মুলা অনুযায়ী যথারীতি জিহাদের মৃত্যুর পরেও আমরা নড়েচড়ে বসলাম। নিজেদের জন্য অপেক্ষমাণ অনিবার্য অপঘাতে মৃত্যুর কথা ভেবে। আত্মসর্বস্ব সমাজের কথা ভেবে। জিহাদ বাংলাদেশের এক সন্ধিক্ষণের অমীমাংসিত চরিত্র বলে, এবং জিহাদের মধ্যে আমরা প্রত্যেকে আমাদের জীবনের অনিশ্চয়তা অনুভব করেছি বলে। নাগরিক সমাজের আরও একটু বেশি সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার কারণ, জিহাদকে ঘিরে তাদের শোক ও ক্ষোভের ওপর অয়েন্টমেন্টের প্রলেপ না বুলিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাইপের মধ্যে জিহাদের অবস্থান অস্বীকার করা হল। যা বলা হল, তাতে আমরা নিজেদেরই মৃত্যুঘণ্টা অবিরাম শুনতে পেলাম। এতদিন জানতাম, টাকার অভাবে দেশ গরিব হয় না, দেশ গরিব হয় ভরসার অভাবে। কতদিন থেকে শুনে আসছি আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছি বা হয়েই গেছি! জিহাদের পর আবার শুনলাম, গর্তে পড়া মানুষ তোলার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিই নাকি আমাদের নেই। সেসব কেনার টাকাও নাকি নাই (আবার শত্রুপক্ষকে গর্তে ফেলে দেয়ার কারিকুরি তো কম জানা নাই)! মধ্যম আয়ের দেশের ক্যাটাগরিটি তবে এই যে, দুর্যোগের সময় তা মোকাবিলা করার টেকনিক্যাল সাপোর্ট থাকে না, তবে একটি গর্তের ভেতর জীব দূরের কথা, জীবাশ্মও নেই- এমনটা বলে দেয়ার টেকনিক্যাল জ্ঞান থাকে। আমাদের টাকার অভাব আছে, সৌজন্যের অভাব আছে। অভাব নাই খালি কূটবুদ্ধির। এ সম্পদে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ নই, এক্কেবারে অতুলনীয়। অনন্য। তো এসব মৌলিক অর্থ সমস্যা নিয়েই আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছি? করোটিতে এসব ভাবনাই সাঁতরে বেড়াচ্ছিল! রাষ্ট্র যে বিপদকালে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পাশে দাঁড়ায় না, সেই অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক আছে (রানা প্লাজা, তাজরিন, নিমতলী)। মানুষই যে মানুষের পাশে নানা সৃজনশীল উপায় বের করে বিপদ ও অনিশ্চয়তাকে মোকাবিলা করে, বেঁচে থাকার বা বেঁচে ওঠার নতুন নতুন পথ খুঁজে নেয়, সেটা লক্ষ করলে মানুষের সহমর্মিতার প্রতি শ্রদ্ধা আসে বটে, তবে শেষ ভরসাটি তো আসতে হবে রাষ্ট্রের কাছ থেকেই। অথচ রাষ্ট্রের কাছে ভরসা না পেয়ে মানুষকে ভরসা খুঁজতে হচ্ছে ব্যক্তিতে। কাজেই জনতার জাগরণে আবেগ উঁকিঝুঁকি দিলেও সেটা যে সমাধানের স্থায়ী পথ নয়, সেই উৎকণ্ঠাও থেকে যায়। ব্যক্তির ক্ষমতা সীমিত; কিন্তু রাষ্ট্রের ওপর রয়েছে বিস্তর দায়িত্ব। কথা ছিল রাষ্ট্র রক্ষা করবে নগর এবং তার নাগরিককে। কোথাও কোনো মৃত্যুকূপ থাকবে না। অথচ দেখা যাচ্ছে, প্রায় শূন্য গহ্বরের ওপর তৈরি হয়েছে আমাদের এ তিলোত্তমা(!) নগর। ‘জিহাদ ট্র্যাজেডি’-তে মানুষের পাশে মানুষ এসে দাঁড়ানোর প্রবণতা আমাদের জন্য খানিকটা আশা তৈরি করেছিল বটে, তবে ৫ জানুয়ারির ঘটনায় সেটুকু মিলিয়ে যায়। মনে হয়েছিল, একটুখানি সত্য আর মানবিকতা বোধহয় আমাদের ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু ৫ জানুয়ারি সেই আস্থার সিংহভাগই গেল লুট হয়ে। পাইপে আটকে থাকা জিহাদকে কেন্দ্র করে দেশের প্রত্যেকটি মানুষের যে আবেগীয় বিপর্যয় বা মানসিক চাপ, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাকে মোকাবিলা করার জন্য কোনো মানবিক সমাধান ছিল না। ছিল না ৫ জানুয়ারির সংকট মোকাবিলা করার ক্ষেত্রেও। না দেখেছি দায়িত্ব, না দরদ। যতই মধ্যম আয়ের বাংলাদেশের কথা বলা হোক, আমরা জানি বাংলাদেশ গরিব। অর্থে যতটা গরিব, তার চেয়ে বেশি গরিব চিন্তায়, যে কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোন জিনিসটি আগে কিনতে হবে তা যেমন আমরা জানি না, তেমন জানি না আমাদের অধিকারের সীমারেখাও। জানি না কোথায় থামতে হবে, তাও। তার চেয়েও বড় সমস্যা জনগণের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব। ফায়ার সার্ভিসের সীমিত সক্ষমতা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ এবং সেবা সংস্থা যদি পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতেন, শ্রম ভাগ করে নিতেন সতর্কতার সঙ্গে, ৫ জানুয়ারির নাজুক মুহূর্তগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি মানবিক ছোঁয়া দিয়ে পূরণ করতেন, তাহলেও খানিকটা আশাবাদী হয়ে ওঠার ব্যাপার ছিল। দুর্ভাগ্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ শব্দযুগলটি কেবল সংবিধানেই লেখা হয়ে থাকল, তন্ত্রের মধ্যে কোথাও গণ সম্পৃক্ততা থাকল না। জিহাদকে জীবিত উদ্ধার করতে পারাটা ছিল ষোলো কোটি মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ। প্রতীকী এবং বাস্তব- দুই অর্থেই। সীমাহীন দুর্যোগে সহযোগিতা আর সহমর্মিতা দিয়ে পরস্পরকে রক্ষা করার বিস্তর দৃষ্টান্ত আছে আমাদের। ঐতিহাসিকভাবেই এ অঞ্চল চর্চা করে আসছে সহনশীলতার ধর্ম। ইতিহাসজুড়ে এ অঞ্চলে আর্যের সঙ্গে অনার্যের, হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের, মুসলমানের সঙ্গে বৌদ্ধের, বৌদ্ধের সঙ্গে হিন্দু ও খ্রিস্টানের অর্থাৎ পারস্পরিক প্রভেদের মধ্যেও ঐক্য স্থাপনের মাধ্যমে টিকে গেছে এ সমাজ। আছে এ ঐক্যের হাজার বছরের ইতিহাসও। বহুর মধ্যে এক’কে প্রতিষ্ঠিত করাই এ অঞ্চলের মূল সুর। সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে একাত্তর। অথচ জনগণের সঙ্গে সরকারের দূরত্বের কারণে যে কোনো দুর্যোগের কালে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কথাবার্তাই অন্য আর সবকিছুর চেয়ে বড় দুর্যোগ হয়ে ওঠে আমাদের কাছে। আর দুর্যোগ মন্ত্রণালয় বলে যে কোনো বস্তু আছে, তা তো আমরা টেরই পাই না। অন্যদিকে আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় না দুর্যোগ, না সুযোগ-কোনোটাই মোকাবিলা করতে সক্ষম নয়। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, শাহ এএমএস কিবরিয়া ও আহসানউল্লাহ হত্যাকাণ্ডসহ এ সময় পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও নৃশংসতার এক করুণ ধারাবাহিকতা মাত্র। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইতিহাস তাই জনগণের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও নৃশংসতার ইতিহাস। কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন, যুক্তিবিচারে সক্ষম এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি কোনোদিন পাব না আমরা?
জয়া ফারহানা : প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.