ব্যবসা-বিনিয়োগ ঘিরে শঙ্কা by এমএম মাসুদ

নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ৫ই জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির জেরে বিএনপি  অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সৃষ্টি হয়েছে সংঘাতময় রাজনৈতিক অস্থিরতা। এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন কয়েকজন নিরীহ মানুষ। ফলে নতুন বছরের শুরুতে হরতাল-অবরোধে বড় ধরনের ঝুঁকির পাশাপাশি মুখ থুবড়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় ২০১৩ সালে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এক ধরনের ভঙ্গুর  দশা নেমে এসেছিল। তবে গত বছর শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকায় ব্যবসায়ীরা সে অবস্থা কাটিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু নতুন বছরের শুরুতে দেশে ফের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে ব্যাহত হয়েছে মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও। মঙ্গলবার থেকে সারা  দেশে পালিত হচ্ছে টানা অবরোধ কর্মসূচি। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলায় ভেঙে পড়েছে সরবরাহ ব্যবস্থা। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অবরোধের প্রথম দিন ব্যবসা-বাণিজ্যে তেমন প্রভাব না পড়লেও এখন ভোগ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সারা দেশে ঠিকমতো পণ্য যাচ্ছে না। অনেক স্থানের আমদানিকারক ট্রাকের অভাবে ঢাকায় পণ্য ও কাঁচামাল পাঠাতে পারছে না। তারা  জানান, এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি চললে তা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। কারখানায় পণ্যের মজুত জমে যাবে। ফলে উৎপাদনও কমিয়ে দিতে বাধ্য হবেন তারা। তারা বলেন, বিদেশী বিনিয়োগকারী ও ক্রেতাদের অনেকেই বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। আবার কেউ কেউ ঢাকায় বিমানবন্দরে নেমে সেখান থেকেই ফিরে যান। এ অবস্থার মধ্যেই হরতাল অবরোধ ব্যবসায়ীদের আরও আতঙ্কগ্রস্ত করছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত নির্বাচনের পর মোট ১৬ দিন হরতাল পালিত হয়েছে। গবেষণা সংস্থা ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মতে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে গত অর্থবছরে কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়নি। কমেছে বেসরকারি বিনিয়োগ তার আগের অর্থবছরের তুলনায়। এ সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল ঋণাত্মক। অন্যদিকে গত কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতির হার কমছে। আগামীতে রপ্তানি কিছুটা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। অর্থনীতিতে গতি ফিরে পাওয়ার এ সময়ে ফের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সমপ্রতি প্রকাশিত চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালের শেষ দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতের পরিণতিতে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা ২০১৪ সালে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব রেখেছে। এর ফলে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি তার আগের বছরের চেয়ে কম হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর, ২০১৪) তুলনামূলক শান্ত পরিবেশের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এ প্রত্যাশার প্রতিফলন কতটুকু ঘটবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে বলে গবেষণা সংস্থাটি মনে করেন।
বিজিএমইএ’র সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, রানা প্লাজা ধস ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পর বিদেশে বাংলাদেশের সুনামহানি ঘটে। ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। ঢাকায় অ্যাপারেল সামিটের আয়োজন করে বিদেশীদের আস্থা ধরে রাখার চেষ্টার পর আবারও হরতাল-অবরোধ ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনবে। তিনি বলেন, গেল বছর এমনিতেই তৈরী পোশাক রপ্তানিতে মন্দাভাব ছিল। এখন ক্রেতারা আসতে শুরু করেছেন,  হরতালের কথা শুনলে তারাও ফিরে যাবেন।
বাংলাদেশ রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে বসে এমন কর্মসূচি ঠিক করতে হবে, যা জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলবে না, অর্থনীতিরও ক্ষতি করবে না, কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ হবে।
এদিকে গত সোমবার সারা দেশে সহিংসতার  আশঙ্কায় দোকানপাট, মার্কেট, বিপণী বিতান, শপিং মল ও ফ্যাশন হাউজগুলোর বেশির ভাগই বন্ধ ছিল। গতকালও দোকানপাট কিছুটা খোলা রাখলেও বেচাকেনা না থাকায় ক্ষতিতে পড়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
দোকানের ব্যবসা ঢিলেঢালা: শপিং মল, বিপণী বিতানসহ সারা দেশে ছোট-বড় ২৫ লাখ দোকান আছে। এসব দোকানে গড়ে তিন হাজার টাকার বেচাবিক্রি হয়। ৫ শতাংশ মুনাফা বাদ দিলেও প্রতিদিন এসব দোকানে লোকসানের পরিমাণ ১৫০ কোটি টাকা। এ হিসাব বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির। সমিতির মতে, গতকাল দোকানপাট খোলাই ছিল। তবে লাভ কি, গ্রাহক নাই। আগের দিনতো দেশের বেশির ভাগ দোকানই বন্ধ ছিল।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ স্থানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দোকান খোলেননি। বড় বিপণী বিতান বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় খোলা থাকলেও ক্রেতা উপস্থিতি ছিল কম। বেচাকেনা তেমন হয়নি। দোকান মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী, হরতাল ও অবরোধে দিনে ক্ষতি প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। বিজিএমইএ’র হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন ৫৫০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। হরতালে এসব পণ্য রপ্তানি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
চলমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংগঠনটি জানায়, চলমান সহিংসতাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অবরোধে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সহিংসতা পরিহার করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছে এফবিসিসিআই। ২০ দলের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন। এক বিবৃতিতে সংগঠনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, ব্যবসায়ীরা একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকা হরতাল ও অবরোধের কারণে দেশে আবারও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে।
এফবিসিসিআইর সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, দেশে রাজনৈতিক যে অস্থিরতা চলছে, তা ব্যবসা-বাণিজ্য আবারও ক্ষতির মুখে ফেলে দিচ্ছে। অর্থনীতির পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা ও শিক্ষা ব্যবস্থাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে, বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতির প্রাক্কালে মুসল্লিদের ঢাকায় আগমন বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
বিপাকে কৃষকরা: ৫ই জানুয়ারিকে ঘিরে সরকার ও বিএনপির পাল্টাপাল্টা রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। বিশেষ করে সবজি চাষিরা। চাষিরা সবজির ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। এসব তথ্য জানিয়েছেন আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা। তারা জানান, গত কয়েক দিনের রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিপুল পরিমাণ সবজি নষ্ট হয়েছে মোকামে ও মাঠে। রাতারাতি সবজির দামও কমে গেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম সবজিবাজার মহাস্থানগড়ে প্রতি কেজি ফুলকপি বিক্রি হয়েছে ১ টাকায়। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গ্রামের কৃষকরা।
সবজির দাম বেড়েছে: রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের কাঁচাবাজারে সরবরাহ-সঙ্কটের অজুহাতে বেড়ে গেছে সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়া বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি ফুলকপি বিক্রি হয়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়। ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষও। কারওয়ান বাজার কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা বলেন, স্বাভাবিক সময়ে যত সবজিবাহী ট্রাক আসছে, এখন আসছে তার অর্ধেকের কম। ভাড়াও বেশি।
চালের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা: অবরোধে রাজধানীর চালের বাজারে এখনও কোন প্রভাব না পড়লেও   অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হলে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আড়তদাররা। অবরোধের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকায় চাল আমদানি বন্ধ রয়েছে। রাজধানীর চালের বিভিন্ন বাজার ঘুরে জানা যায়, বাজারে প্রচুর মজুদ থাকায় বাইরে থেকে চাল না এলেও গত কয়েক দিনে তার কোন প্রভাব পড়েনি।
আটকে আছে পণ্য: দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর থেকে ট্রাকসঙ্কটে অনেক ব্যবসায়ীই ঢাকায় পণ্য পাঠাতে পারেননি। এর মধ্যে বেনাপোল ও পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর অচল হয়ে পড়েছে। এসব বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে রয়েছে। এতে স্থলবন্দরটির উভয় পাশে শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক আটকে আছে।

No comments

Powered by Blogger.