ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত নয়, শান্তি চাই

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সমাজবদ্ধ মানুষের একত্রে বসবাস বা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করার মানসিকতা গড়ে উঠেছে। এর সুবাদে গড়ে উঠেছে পারস্পরিক বন্ধুত্বসুলভ মানসিকতা ও আচার-আচরণ। কিন্তু ক্ষমতার লড়াইয়ে তুচ্ছ কারণে বন্ধুপ্রতিম দল-মত ও গোষ্ঠীর সঙ্গে মানুষের প্রায়ই বাগিবতণ্ডা, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, প্রতিযোগিতা ও প্রতিহিংসা লেগেই থাকে। একপর্যায়ে এটি বর্বরতা, হানাহানি ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও সহিংসতায় রূপ নেয়। কেউ চিন্তা করে না প্রতিপক্ষ ব্যক্তি তার আত্মীয়স্বজন, ভাই-বন্ধু বা নিকটতম প্রতিবেশী হতে পারে! যেমনিভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা দিয়েছেন, ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। কাজেই সে কোনো মুসলমানের ওপর জুলুম করতে পারে না এবং কোনো মুসলমানকে মজলুম অবস্থায় ফেলেও যেতে পারে না। যে ব্যক্তি অপর ভাইয়ের উপকারে রত থাকে, আল্লাহ তার উপকারে রত থাকেন। যে কোনো মুসলমানের কষ্ট দূর করে, আল্লাহ তার কিয়ামতকালীন কঠিন কষ্ট দূর করে দেন। যে কোনো মুসলমানের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবেন।’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ) পৃথিবীতে যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ন্যায়-অন্যায়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বহু দেশ ও জাতি ধ্বংসের পথে চলেছে। অশান্তি-বিশৃঙ্খলা, দ্বন্দ্ব-কলহ, ঝগড়া-বিবাদসহ যাবতীয় বিবাদের সমাধান থেকে শুরু করে জনজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা, উন্নয়ন-অগ্রগতি, কল্যাণ-সমৃদ্ধি এবং সঠিক সময়োপযোগী বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তের জন্য জাতীয় সংলাপ,
বৃহত্তর দলমতের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করার জন্য মানুষকে সাবধান করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর তোমরা বিপর্যয় ঘটাবে না।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ৮৫) শান্তিকামী জনগণের জীবন ও জীবিকার মৌলিক অধিকার পূরণের তাগিদ সত্ত্বেও দলমতের পারস্পরিক সুসম্পর্কের, ন্যায়বিচারের এবং সঠিক সময়ে নেতাদের যৌক্তিক সিদ্ধান্তের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে ভূপৃষ্ঠে যাবতীয় মন্দ, দুষ্কর্ম ও দুর্নীতির আবির্ভাব ঘটেছে মর্মে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে তাদেরকে তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সূরা আর-রুম, আয়াত: ৪১) কারও প্রাণহানি, সম্পদ দখল, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে বিনষ্ট করলে বা কোনো দেশে বহিঃশত্রু আক্রমণ করলে আত্মরক্ষার বিধান ইসলামে স্বীকৃত। কেননা, ইসলামের যুদ্ধনীতি প্রতিরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক নয়; এমনকি প্রতিশোধমূলকও নয়।
আত্মরক্ষার্থে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জীবনে অনেক যুদ্ধ, সংলাপ ও সন্ধি করতে হয়েছে। বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সব অন্যায়-অত্যাচার-অবিচার পদদলিত করে ন্যায়, সত্য, ইনসাফ, সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষা করতে গিয়ে শত্রু কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তিনি প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ‘যুদ্ধ’ মানেই যেখানে বিভীষিকা, মৃত্যু ও ধ্বংস; সেখানেও মহানবী (সা.) বলেছিলেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতারণা করা যাবে না, বিশ্বাস ভঙ্গ করা যাবে না, নিহত ব্যক্তির অঙ্গচ্ছেদ করা যাবে না, নারী-শিশু-বৃদ্ধদের হত্যা করা যাবে না, শত্রু হলেও প্রার্থনারত অবস্থায় কোনো ব্যক্তিকে আঘাত করা যাবে না। ফলদায়ী গাছ কাটা যাবে না।’ কী অকল্পনীয় উদার এই যুদ্ধনীতি! এমনকি বিদায় হজের ভাষণে নবী করিম (সা.) বিনা অপরাধে একজন নিরীহ মানুষকেও হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে সমাজে পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মাধ্যমে সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি অটুট থাকে; ফলে মানুষের মন থেকে স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা ও হূদয়হীনতার পাশবিক বৈশিষ্ট্যগুলো দূরীভূত হয়ে যায়। একা একজন মানুষ বা একটি দলকে নিয়ে যেমন সমাজ রচিত হয় না,
তেমনি এককভাবে মানুষ নিজের জানমালের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারে না। ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও কলহ-বিবাদ নিরসনে পারস্পরিক সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে শান্তির পথে চলার উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেই মানুষের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়। তখন ধৈর্যশীল মানুষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমঝোতার সুফল সৃষ্টি করে, যা পবিত্র কোরআনে ব্যক্ত হয়েছে: ‘নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, তাহলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে; আর তোমরা ধৈর্য ধারণ করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪৬) তাই সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হতে হবে উদার, সহনশীল, বিনয়ী, পরোপকারী, দেশপ্রেমিক, মানবদরদি, জনসেবী, আত্মত্যাগী, ক্ষমতার প্রতি নির্লোভ, নিরহংকার, সুবিচারক, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাকারী এবং অন্যায়ে বাধা প্রদানকারী প্রভৃতি সৎ গুণের অধিকারী। তাহলেই দেশে কাঙ্ক্ষিত শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করবে এবং জনসাধারণ সব ধরনের নিরাপত্তাহীনতা ও ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব-সংঘাত এড়িয়ে দুর্যোগ ও দুর্ভাবনামুক্ত হয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র দলমত-নির্বিশেষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও নিরাপদে বসবাস করতে পারবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.