গণতন্ত্র ও রাজনীতির কূটনীতি by আলী ইদ্‌রিস

রাজনীতির মারপ্যাঁচ বা রাজনীতির কূটনীতি যে কত জটিল ও দুর্জ্ঞেয় বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন জোট তা প্রমাণ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ এখন গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার রক্ষা এবং সংবিধানকে সমুন্নত রাখার নামে যে নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে তা বিস্ময়কর, অভূতপূর্ব। দেশব্যাপী একটি জাতীয় নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বিনা ভোটে, বিনা মেনিফেস্টোতে প্রার্থীগণ ১৫৪টি আসন দখল করে নেন, এ জাতীয় নজির অতীতে ছিল না, ভবিষ্যতেও হয়তো দুর্লভই থেকে যাবে। রাজনীতি যে জননীতি নয়, বরং রাজা-মহারাজার দ্বারা প্রজাদেরকে শাসন করার নীতি তা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদগণ দেখিয়ে দিয়েছেন। অন্যান্য দেশকে বাংলাদেশের নিকট থেকে রাজনীতির কূটনীতি বা মারপ্যাঁচ শেখার সবক নেয়া উচিত। রাজনীতির দুর্জ্ঞেয়, জটিল ও অসুস্থ কূটনীতির নিকট গণতন্ত্র পদপিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে, অথচ রাজনীতিবিদগণ উচ্চস্বরে ভাষণ দিচ্ছেন, গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে, মানুষের ভোটাধিকার সংরক্ষণ করতে হবে, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। অধমের একটি প্রশ্ন, ১৫৪টি আসনের ভোটাররা কি অপরাধ করেছিল যে তারা ভোট দিয়ে তাদের পছন্দমতো প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারলেন না, তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ ছাড়াই তাদের ওপর প্রতিনিধিত্ব চাপিয়ে দেয়া হলো? অন্য কথায়, ভোটাররা ভোট দিক আর না দিক, পছন্দ করুক আর না-ই করুক তাদের নেতা নির্বাচিত হয়ে গেল। আরও অদ্ভুত ব্যাপার, একজন প্রার্থী তার আসনটি জাপার একজনকে গিফ্‌ট করতে চাইলেন, হয়তো সেটা গ্রহণ করাও হবে। এটা কি গণতন্ত্র, অর্থাৎ জনগণের নির্বাচন করার সুযোগ নেই, তাদেরকে যে প্রতিনিধি দেয়া হবে তাকেই গ্রহণ করতে হবে। এভাবে কি মানুষের সাংবিধানিক ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হলো না? আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী গণতন্ত্রমনা দল রাজনীতির কূটনীতিতে পরিপক্ব হয়েছে বটে, কিন্তু গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। কূটনীতির মারপ্যাঁচে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে এক হাত দেখিয়ে দিয়েছে। এটা আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব, কিন্তু বিএনপির ১৯৯৬ সালের মতো একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠান করে তারা মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবে কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু জনগণ আজ স্তম্ভিত, বিস্ময়াভিভূত এই দেখে যে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কূটনীতি জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব তারানকোর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, জাতিসংঘের মহাসচিবের ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিবের টেলিফোন কলকেও কোন মূল্য দেয়নি। উল্টো তারানকোর প্রস্তাবিত সংলাপ চালাতে হলে এখন মধ্যবর্তীকালীন অথবা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সংলাপ করতে হবে। কি চমৎকার কূটকৌশল! অনুমান করা হচ্ছে, ৫ই জানুয়ারির আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যের সংখ্যা দু’ শ’ ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাহলে জনগণের শ’ শ’ কোটি টাকা খরচ না করে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিলেই পারে যে, মহাজোট সরকার যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে গেছে, সেহেতু নির্বাচনের আর প্রয়োজন নেই, ৫ই জানুয়ারির মধ্যে যদি ১৮ দলীয় জোট নির্বাচনে না আসে তাহলে ৩০০ আসনই মহাজোট পাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্য উদারতার সঙ্গে বলেছেন যে, বিএনপি যদি সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিতো তাহলে তাদেরকে সমঝোতায় আসন ছেড়ে দেয়া হতো। সমঝোতার মাধ্যমে এভাবে প্রতিবারই আসন ভাগাভাগি হয়ে গেলে নির্বাচনের খরচ অন্তত ৫০০ কোটি টাকা বেঁচে যায়। বিরোধী দল বিএনপিরও অনেক ভ্রান্তি রয়ে গেছে। তারা আজ যে আন্দোলন করেছে সেটা লেজে-গোবরে হয়ে গেছে, সহিংসতা কেউ চায় না। তিন বছর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যখন বিলুপ্ত করা হলো, তখনই তাদেরকে সংসদে ও রাজপথে সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল এবং সর্বশক্তি দিয়ে সংগ্রাম করে দাবি আদায় করা উচিত ছিল। তাহলে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু নিয়ে ৩ বছর ধরে এত হরতাল হতো না, এত অবরোধ, সহিংসতা এবং দেশের এত বড় অর্থনৈতিক ক্ষতি হতো না। আজ ৩ বছরে অন্তত ৪৫,০০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি দেশ তথা জনগণকে বহন করতে হয়েছে। তদুপরি মানুষের অসীম মানসিক ভোগান্তি, শান্তিতে বসবাস করার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে, বিশ্বের বুকে দেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ফ্যাকাশে হয়েছে। এসব ক্ষতির জন্য বিএনপি ও ক্ষমতাসীন মহাজোটকে সমানভাবে দায়ী করা যেতে পারে। কারণ সব কিছুর পিছনে একতরফা ভাবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করাই এ অবস্থার জন্য দায়ী, তারপরও বিএনপি সংসদে গিয়ে, সংলাপে যোগ দিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য সর্বদলীয় সরকারে বিএনপিকে আনতে না পারার পিছনে সরকারের আন্তরিকতার অভাব ছিল বলেই তারা যোগ দেয় নি। তাই খালি মাঠে আওয়ামী লীগ গোল করছে। এর ফলে ৪ কোটি ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছেন, গণতন্ত্র পদপিষ্ট হয়েছে, সংঘাত-বিঘ্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, আগুনে পুড়ে মানুষ মরছে, অর্থনীতি প্রকটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারের যৌথ বাহিনীও কোন কোন স্থানে পরিস্থিতি দমনে গলদঘর্ম হচ্ছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, দশম সংসদের নির্বাচিত সরকারের যে তীর্যক, তীক্ষ্ন স্পিরিট, যে শক্ত মনোবল থাকার কথা, তা কি এ নতুন সরকারের থাকবে? তারা কি দেশের সঙ্কটসঙ্কুল সমস্যার সমাধান করতে পারবেন? সময়ই তা বলে দেবে।

aliidris446@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.