জনস্বাস্থ্য- নিষিদ্ধ ওষুধের শিকার আমরা by ড. আবুল হাসনাত ও মো. মোমিনুর রহমান

ওষুধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন-মরণ সম্পর্ক। এ কারণে ওষুধের প্রতি মানুষের দুর্বলতা অপরিসীম। ১৯৮২ সালের পর থেকে বাংলাদেশে ওষুধশিল্পের বিপ্লব শুরু হয়।
আজকের এই ২০১৩ সালে এসে আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশ ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশে ওষুধের বাজার প্রায় ৩০ হাজার মিলিয়ন টাকা, যার বৃদ্ধির হার ২৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ। বিশ্বের প্রায় ৮২টি দেশে আমাদের ওষুধ রপ্তানি হয় এবং ইউরোপীয় দেশগুলোতে আমাদের ওষুধের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ওষুধপ্রযুক্তি, উৎপাদন, বিপণনে আমরা এগিয়ে গেলেও ওষুধের পর্যবেক্ষণ, ওষুধের স্বতঃস্ফূর্ত নিরীক্ষা, প্রেসক্রিপশন পর্যালোচনা, ওষুধের রেকর্ড, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওষুধের সমসাময়িক ডেটাবেইস তৈরি করা নিয়ে আমরা এখনো পিছিয়ে রয়েছি। একটি ওষুধ বাজারে আসার আগে বিভিন্নভাবে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। প্রথমত, পরীক্ষাগারে বিভিন্ন প্রাণীর ওপর অনুসন্ধান চালিয়ে তারপর তা মানবদেহে পরীক্ষা করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওষুধের কার্যকারিতা ও তার নিরাপদ একটা প্রোফাইল তৈরি করা হয়। এরপর ওষুধটি যখন সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য বাজারে ছাড়া হয় তখন চতুর্থ ধাপ হিসেবে খুব সতর্কতার সঙ্গে নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় ওষুধটির কোনো খারাপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না। ফার্মেসির ভাষায় একে বলা হয় ফার্মাকোভিজিলেন্স। এ ক্ষেত্রে ওই ওষুধটির যদি মারাত্মক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, যেটি ওষুধটির উপকারের চেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় অথবা ওষুধটি তার যথাযথ কার্যকারিতা প্রদর্শন না করে, তখন ওই ওষুধটি সংশ্লিষ্ট দেশের ওষুধ কর্তৃপক্ষ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

২.
সমপ্রতি ব্রিটিশ মেডিকেল সাময়িকী, আমেরিকান জার্নাল অব ম্যানেজড কেয়ারসহ বিশ্বের নামকরা কিছু সাময়িকীতে এবং আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (এফডিএ) বেশ কিছু ওষুধকে মানবজীবনের ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে পাইওগ্লিটাজোন, রোসিগ্লিটাজো, ফ্লুপেনটিক্সল-মেলিট্রাসিন, গ্যাটিফ্লক্সাসিন, টেগাসেরড, সিবুট্রামিন উল্লেখযোগ্য।

৩.
ক্যানসারের জন্য দায়ী বিবেচনা করে ২০১১ সালে ফ্রান্স ও জার্মানিতে নিষিদ্ধ হয়ে যায় টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জন্য বহুল ব্যবহূত পাইওগ্লিটাজোন। একইভাবে হূদেরাগজনিত মৃত্যুর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় ডায়াবেটিসের অপর ওষুধ রোসিগ্লিটাজোনকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপে ওষুধটি বন্ধ হয়ে যায়। ডেনমার্ক মেডিকেল কর্তৃপক্ষ তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য ডেনমার্কে প্রথম উৎপাদিত ডেনাজিট (ফু্লপেনটিক্সল-মেলিট্রাসিন) বন্ধ ঘোষণা করে। পরে ওষুধটি বন্ধ হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ উন্নত বিশ্বে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত কানাডিয়ান এক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার বিবেচনায় ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) গ্যাটিফ্লক্সাসিন অ্যান্টিবায়োটিককে বাজারজাত বন্ধ করে দেওয়ার জন্য মতামত ব্যক্ত করে। মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে তীব্র বুকব্যথা, শ্বাসকষ্ট, হঠাৎ দুর্বল হওয়ার আশঙ্কার কথা চিন্তা করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য ব্যবহূত টেগাসেরডকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সমপ্রতি গবেষণায় ১৬ শতাংশ রোগীর হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বিবেচনায় ওজন কমানোর ওষুধ সিবুট্রামিনকে বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন।

৪.
কিন্তু আশঙ্কার কথা এই যে বাংলাদেশে এই রকম ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন ওষুধের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতামত অনুসারে, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে অ্যাডভার্সড ড্রাগ রি-অ্যাকশন মনিটরিং কমিটি গঠিত হলেও এর নিয়মিত কার্যক্রম চোখে পড়ে না। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পাবলিক নোটিশ বিভাগেও এজাতীয় কোনো তথ্য নেই।

৫.
প্রশ্ন হচ্ছে, এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? এর জন্য আমাদের খুবই সচেতন হতে হবে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওষুধ প্রশাসনকে এ ব্যাপারে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। ডাক্তার, ফার্মাসিস্টসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ওষুধ নিয়ে সর্বদা নিত্যনতুন তথ্য সংগ্রহ করা উচিত। সেই সঙ্গে ওষুধ কোম্পানিগুলোর পোস্ট মার্কেটিং সার্ভিলেন্সকে জোরদার করে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ ওষুধের বাজারজাত বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করাও খুব প্রয়োজন। মানুষের মূল্যবান জীবন বাঁচাতে ও জীবন সাজাতে, ওষুধ নিয়ে অনিশ্চয়তা ও ভোগান্তি থেকে উদ্ধারকল্পে এবং বাংলাদেশের ওষুধ নিয়ে জনসাধারণের যে আস্থা রয়েছে, তা টিকিয়ে রাখতে অনতিবিলম্বে যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
ড. আবুল হাসনাত: অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ahasnat99@yahoo.com
মো. মোমিনুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, আইআইইউসি।

No comments

Powered by Blogger.