হাজি মুহম্মদ মুহসীন মৃত্যুর ২০০ বছর পর by অমর সাহা

দানবীর হাজি মুহাম্মদ মুহসীনের মৃত্যুর ২০০ বছর পূর্ণ হলো গত নভেম্বরে। এ নিয়ে তাঁর জন্মস্থানে ছিল নানা অনুষ্ঠান। এই মানবহিতৈষীর জন্মভিটা ঘুরে তাঁর কথা স্মরণ করলেন প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি অমর সাহা
এখনো তিনি মানুষের হূদয়ে জাগ্রত—সেই হুগলী থেকে গোটা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে সুদূর বাংলাদেশেও। তিনি হাজি মুহম্মদ মুহসীন। মৃত্যুর ২০০ বছর পরও এতটুকু ম্লান হয়নি তাঁর স্মৃতি, কীর্তিগাথা। আজও তিনি দানবীর হিসেবে অমর, প্রাতঃস্মরণীয়।

ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনে আসছি দানবীর হাজি মুহম্মদ মুহসীনের কথা। আজ সেই তিনি নেই। এই তো সেদিন, ২৯ নভেম্বর চলে গেল এই মহান পুরুষের মৃত্যুদিন। হুগলীর ইমামবাড়াসহ সর্বত্র দিনটি পালিত হলেও কলকাতায় ছিল না কোনো আয়োজন। হুগলীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ২০০ বছর পূর্ণ হওয়া এই মৃত্যুদিবসকে ঘিরে তিন দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এ উপলক্ষে কলকাতা ও ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে আসেন বহু খ্যাতিমান বিশিষ্টজন।

হাজি মুহসীন জন্মেছিলেন ১৭৩২ সালের ১ আগস্ট। তাঁর পিতা হাজি ফয়জুল্লাহ। জানা যায়, তাঁর পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন সুদূর ইরান বা পারস্য থেকে। তবে তাঁদের আদি বাস ছিল আরবে।

দিল্লির মসনদে তখন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব। সম্রাটের বিচারালয়ের সম্মানিত সদস্য ছিলেন আগা মোতাহার। আওরঙ্গজেব আগা মোতাহারের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যশোর, হুগলী, নদীয়া ও ২৪ পরগনা জেলার প্রচুর জমি তাঁকে জায়গীর দেন। এরপরে আগা মোতাহার হুগলীতে বসবাস শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে ছিল স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে মন্নুজান। তবে কিছুদিন পর মারা যান আগা মোতাহার। পরে আগা মোতাহারের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেন মুহসীনের বাবা হাজি ফয়জুল্লাহ। মন্নুজান হয়ে যান মুহসীনের বোন। তাঁদের বাবা-মা মারা গেলে ভাইবোন হয়ে পড়েন অভিভাবকহীন। বিশাল সম্পত্তির মালিক হন মন্নুজান। একসময় তিনি বিয়ে করেন আগা সালাউদ্দিনকে, যিনি কর্মসূত্রে সে সময় ইরান থেকে এসে হুগলীতে বাস গেড়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসন্তান মন্নুজান তাঁর সম্পত্তি মুহসীনকে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু এতে রাজি হননি মুহসীন।

অবশেষে মন্নুজান ১৮০২ সালে সমুদয় সম্পত্তি লন্ডনের সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে মুহসীনকে দান করেন। পরে মুহসীন ১৮০৬ সালের ২০ এপ্রিল হুগলীতে এক অছিয়তনামা রেজিস্ট্রি করেন। তাতে মেধাবী ছাত্রছাত্রীসহ মুসলিম সমাজের উন্নয়নের জন্য তাঁর সম্পত্তি থেকে আয়ের অর্থ ব্যয় করার কথা বলেন। আহমদ ছফার যদ্যপি আমার গুরু বইয়ে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তথ্য দিয়েছেন, ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও নাকি মুহসীন ফান্ড থেকে ছাত্রবৃত্তি পেয়েছিলেন।

মুহসীন ট্রাস্টের অন্যতম এক কর্মকর্তা হুগলীর বাসিন্দা মীর্জা মহম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, হুগলীর ঐতিহাসিক ইমামবাড়া যেখানে অবস্থিত, তার মাঝখানে ওজুর জন্য যে জলাশয় তৈরি করা হয়েছে, সেখানেই ছিল মুহসীনের প্রথম ছোট্ট ইমামবাড়া। এখানেই একসময় থাকতেন তিনি। মুহসীনের মৃত্যুর পর তাঁর অগাধ অর্থ থেকে তৈরি হয়েছিল ৪২ বিঘা জমির ওপর এই ইমামবাড়া।

তিনি আরও জানান, এর সামনের দুটি চূড়ার উচ্চতা ১৫০ ফুট। ইমামবাড়া নির্মাণ শুরু হয় ১৮৪১ সালে। তখন খরচ হয় আট লাখ ৫০ হাজার টাকা। এটির নকশা সংগ্রহ ও নির্মাণ করেন ইঞ্জিনিয়ার মাওলানা সৈয়দ কেরামত আলি—ভারতের উত্তর প্রদেশের জৈনপুরের বাসিন্দা। তিনি ইরানের কাজমাইন থেকে এই ইমামবাড়ার নকশা আনেন। এই ইমামবাড়ায় রয়েছে সুন্দর একটি মসজিদ। মসজিদের গাত্রে লেখা আছে কোরআনের আয়াত। এ ছাড়া রয়েছে আরবি, উর্দু ও পারসি শেখার বিদ্যালয়—নাম ’হাওজা-ই-ইলমিয়া’।

এই ইমামবাড়ার পেছনে হুগলী নদীর তীরে রয়েছে একটি সূর্যঘড়ি। এই সূর্যঘড়ির ওপর পড়া সূর্যের আলোর ছায়া থেকে বোঝা যেত সময়।

আর ইমামবাড়ার সামনের দুটি বিশালকায় চূড়ার মাঝে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক ঘড়ি। এই চূড়ায় উঠতে ১৫২টি সিঁড়ি পার হতে হয়। ঘড়িটি লন্ডনের বাকেন্ড মারি কোম্পানির বিগবেন ঘড়ি। পৃথিবীতে এখন এই ধরনের আরও একটি ঘড়ি রয়েছে লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদে। ইমামবাড়ার ঘড়িটি কেনা হয় ১৮৫২ সালে ১১ হাজার ৭২১ টাকায়। সেদিন এটি মহারানি ভিক্টোরিয়া দান করতে চাইলেও তা গ্রহণ করেনি ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষ। এই ঘড়িতে আছে বিশালকায় তিনটি পিতলের ঘণ্টা—৮০, ৪০ ও ৩০ মণ ওজনের। এর চাবির ওজন ২০ কেজি। সপ্তাহে এক দিন ঘড়িতে চাবি দিতে হয়। চাবি দিতে লাগে দুজন।

হাজি মুহম্মদ মুহসীনের কত সম্পত্তি ছিল বা এখন আছে তার সঠিক হিসাব কেউ দিতে পারেননি। হুগলীর বাসিন্দা শেখ লুৎফর রহমানের মতে, মুহসীন এস্টেটের অধিকাংশ সম্পত্তি ছিল বাংলাদেশের যশোর ও খুলনায়। এর পরিমাণ এক হাজার ৮০০ একরের মতো। তখন যশোর ও খুলনার মুহসীন এস্টেট থেকেই ৬৫ হাজার টাকার কর আসত। আর গোটা মুহসীন এস্টেট থেকে আয় হতো এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েই রক্ষণাবেক্ষণ হতো মুহসীন এস্টেট, বিশেষত ইমামবাড়া ও মুহসীনদের পারিবারিক কবরস্থান। লুৎফর রহমান আরও জানান, যশোর ও খুলনা বাদে হুগলীর চুঁচুরা, হাজিনগর, নদীয়ার কল্যাণী, মুর্শিদাবাদ, কলকাতার খিদিরপুর এবং পদ্মপুকুরেও রয়েছে মুহসীনের অন্তত এক হাজার ৪০০ একর সম্পত্তি। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, কেবল হুগলীতেই রয়েছে ১২ হাজার বিঘা সম্পত্তি। তবে এ বিপুল সম্পত্তির অধিকাংশই এখন বেহাত।

মুহসীন এস্টেটের আয় থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হুগলী মুহসীন কলেজ, হুগলী মাদ্রাসা এবং হুগলীর জেলা হাসপাতাল ‘ইমামবাড়া সদর হাসপাতাল’। আর এই আয় থেকে এখনো দুস্থ ও মুসলিম কৃতী ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া হয় বৃত্তি। এ বছরও ২০ হাজার রুপি করে বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে ১০৬ জন ছাত্রছাত্রীকে।

ইমামবাড়ার একটু দূরেই মুহসীনের পারিবারিক কবরস্থান। এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন হাজি মুহম্মদ মুহসীন, মন্নুজান খানম, মুহসীনের মা জয়নাব বেগম, ভগ্নিপতি আগা সালাউদ্দিন, বাবা হাজি ফয়জুল্লাহ ও ইঞ্জিনিয়ার আগা মোতাহার।

স্থানীয় মানুষজন চাইছেন, এই ইমামবাড়াকে সংস্কার করে টিকিয়ে রাখা হোক মুহসীনের স্মৃতিকে। এখানে গড়া হোক একটি পর্যটন কেন্দ্র। এ জন্য এখন প্রাথমিক পর্যায়ের কাজও শুরু হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.