কালের পুরাণ স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী কহেন... by সোহরাব হাসান

সব সম্ভবের বাংলাদেশে অনেক অস্বাভাবিক ঘটনাই ঘটে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের কাছে স্বয়ং স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর লিখিত নালিশ অভিনবই বটে।
কেননা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতি বা অন্য কোনো অপরাধ করলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব প্রতিমন্ত্রীরই। তিনি না পারলে মন্ত্রীকে বলবেন। মন্ত্রী না করলে প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন। সেসব না করে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি লেখার কী যুক্তি থাকতে পারে?
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিচালনার জন্য যে তিন মহারথীকে প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই; কিন্তু স্বার্থ উদ্ধারের প্রতিযোগিতা আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) মজিবুর রহমান ফকির ও উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। তিন চিকিৎসকের কবলে পড়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এখন ত্রাহি অবস্থা। এঁদের কেউ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদনের দায়িত্ব পালন করেন, কেউ চিকিৎসকদের পদায়ন ও পদোন্নতি দেখেন, কেউ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হম্বিতম্বি করেন। কিন্তু দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেই।
শোনা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার সেফায়েত উল্লাহর সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সম্পর্ক খুবই ভালো এবং প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। আর সেই টানাপোড়েনের পরিণাম হলো চিঠি।
প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান ফকির ৪ জুন দুদকের চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠি লেখেন। চিঠির ওপরে লেখা ছিল ‘গোপনীয়’। এই চিঠির ভাষা ছিল নিম্নরূপ: ‘আমার শুভেচ্ছা নিবেন। আশা করি ভালো আছেন। আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ব্যাপক উন্নয়নের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন অন্যতম। বিশেষ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হতে এ খাতের উন্নয়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে বিভিন্ন উন্নয়ন/সেবামূলক কার্যক্রমের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কিছু উন্নয়নের কার্যক্রম সমাপ্তির পথে। অন্যগুলো দ্রুত শেষ হবে বলে আমি আশাবাদী। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, সেবা খাতের উন্নয়নে বেশি ভূমিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের থাকা সত্ত্বেও অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নানা দুর্নীতি ও অপকর্মের কারণে তা আজ হুমকির মুখে। এর দুর্নীতির চিত্র গত ০৮.০২.১৩ ইং হতে পর্যায়ক্রমে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার মাধ্যমে ১২.০২.১৩ তারিখ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়; যা দেশে ও দেশের বিভিন্ন মহলে আলোচনার ঝড় ওঠে। আমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মহাপরিচালকের কাণ্ড দেখে লজ্জাবোধ করি। আমি একজন সচেতন নাগরিক এবং ১৯৭১-এর রণাঙ্গনের বীর সৈনিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সবিনয় অনুরোধ করছি। (পত্রিকার কাটিং সংযুক্ত ০৩ পাতা)
ধন্যবাদান্তে
ডা. ক্যাপ্টেন (অব.) মজিবুর রহমান ফকির, এমপি’
দুদকের চেয়ারম্যানের বরাবর লেখা স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর এই চিঠি গ্রহণ করেন দুদকের পরিচালক উইং কমান্ডার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ হিসেবে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম আলোয় প্রকাশিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি প্রতিবেদনের ফটোকপিও যুক্ত করেন। এখানে লক্ষ করার বিষয়, তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে বলেননি। সরাসরি ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
প্রতিমন্ত্রী যখন জানতে পেরেছেন যে তাঁরই মন্ত্রণালয়ের একটি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দুর্নীতির কারণে সরকারের উন্নয়নকাজ হুমকির মুখে, তখন তাঁর দায়িত্ব কি শুধু দুদকের চেয়ারম্যানকে চিঠি লেখা এবং পত্রিকার কাটিং পাঠিয়ে দেওয়া? মহাপরিচালকের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে। আর তিনি দুদকের চেয়ারম্যানকে চিঠি লিখেছেন জুন মাসের ৪ তারিখে।
এত দিন পর এই চিঠি পাঠানোর উদ্দেশ্য কী?
অনুসন্ধানে জানা গেল, গত বছরের নভেম্বরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে বিভিন্ন জেলায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এসব পদের বিপরীতে দরখাস্ত জমা পড়ে এক লাখেরও বেশি এবং যাচাই-বাছাই করে ৭৭ হাজার প্রার্থী বাছাই করা হয়, তাঁদের মধ্য থেকে ৬৬ হাজার প্রার্থী পরীক্ষা দেন। এখনো ফল প্রকাশ করেনি বা নানা চাপে করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কারণ, উল্লিখিত পদে নিয়োগ দিতে মন্ত্রী, সাংসদসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে সুপারিশ করা হয়েছে এক হাজার ৬০০ জনের জন্য। আর সেখানেই স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর চিঠির আসল রহস্য লুকিয়ে আছে। তিনি একাই সুপারিশ করেছেন ৪৩৬ জনের নামে। (২৪ জুন প্রথম আলো)।
বিষয়টি লক্ষ করুন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ ওই মন্ত্রণালয়ের সবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। সেই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সুপারিশ এলে মহাপরিচালক কী করবেন? তা-ও সাধারণ সুপারিশ নয়, নিয়োগ করার তাগিদ।
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ৪ জুন দুদকের চেয়ারম্যানের কাছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি লিখেছেন, সেই একই পরিচালকের কাছে ৪৩৬ জনের চাকরির তদবির করেছেন। সেই চিঠির ভাষা এরূপ:
‘আমার শুভেচ্ছা নিবেন। আশা করি ভালো আছেন। আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় ( বিভিন্ন জেলার নাম) সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ করা হবে। নিম্নবর্ণিত প্রার্থীদের নিয়োগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশসহ প্রেরণ করা হলো।’
তাঁদের মধ্যে একজন প্রার্থীর পক্ষে আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাসের সুপারিশে তিনি দ্বিতীয়বার সুপারিশ করেছেন।
স্বাস্থ্যসেবায় বর্তমান সরকারের সাফল্য কম নয়। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে ব্যাপক সফলতা আছে। কমিউনিটি ক্লিনিক ফের চালু করে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার দাবিও করছে তারা। এই সরকারের আমলে পাঁচ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়েছে। চার হাজার ১২৬ জন সেবিকা নিয়োগের প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত। সরকারি হাসপাতালগুলোয় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহেও অগ্রগতি আছে, যদিও কোনো কোনো হাসপাতালে মূল্যবান যন্ত্রপাতি পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আবার বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদন, আসনসংখ্যা বাড়ানো, চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের পদায়ন, পদোন্নতির জন্য উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগও আছে। সর্বোপরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা অনেকটাই বেহাল তিন শীর্ষ নীতিনির্ধারকের দ্বন্দ্বে। এই দ্বন্দ্বের কারণে মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, যিনি অত্যন্ত সৎ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
যে মন্ত্রণালয়ে তিন কুতুব, সেই মন্ত্রণালয় আসলে কে চালান, বলা কঠিন। সাফল্যের ভাগীদার সবাই। ব্যর্থতার দায় নিতে চান না কেউ। তদবিরেও তাঁরা পিছিয়ে নেই। এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোদাচ্ছের আলী মন্ত্রণালয়ের সব পদোন্নতির বিষয়ে খবরদারি করতেন বলে অভিযোগ আছে। কখনো কখনো তিনি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে ডিঙিয়ে কাজ করতেন। গত বছর হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়ে পড়ায় তিনি এখন মন্ত্রণালয়ের কাজে তেমন সক্রিয় নন। মন্ত্রণালয়ের সভায়ও তাঁকে দেখা যায় না। তবে সরকার সম্প্রতি ডব্লিউএইচওর আঞ্চলিক পরিচালক পদে তাঁর নাম মনোনয়ন দেওয়ায় দুর্মূখেরা এটিকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পুরস্কার বলেও হাসিঠাট্টা করছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, তাঁর নাম থাকায় বাংলাদেশ নির্বাচনে হেরে যেতে পারে। বিএমএ নির্বাচনেও তাঁর হস্তক্ষেপ ছিল।
পাঠকের মনে থাকার কথা, বছর দুই আগে এই উপদেষ্টা গোপালগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে বেছে বেছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীদের সরকারি শূন্য পদে নিয়োগ করার কথা বলেছিলেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির খতিয়ান বেশ লম্বা। বর্তমানে দেশে ৫৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে, যার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই সরকারের আমলে।
গত ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত বেশ কটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার একটির ক্ষেত্রেও সরকার ব্যবস্থা নেয়নি মামুলি তদন্ত কমিটি গঠন ছাড়া। আর এসব তদন্ত কমিটি নিয়েও ঢের বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। ১১ ফেব্রুয়ারি মহাপরিচালকের মহাকাণ্ড নামে প্রথম আলোয় যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তার সারকথা ছিল: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সেফায়েত উল্লাহ একটি পরিকল্পনার প্রধান (লাইন ডিরেক্টর) হিসেবে দৈনিক এক লাখ ১২ হাজার ৮৮৭ টাকা করে সম্মানী নিয়েছেন। ১২৪ দিনে তাঁর নেওয়া সম্মানীর পরিমাণ ৩৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। তাঁর বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে রয়েছে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায় উপস্থিত না থেকেও সম্মানী নেওয়া, দরপত্র ছাড়া ছয় কোটি ৬৬ লাখ দুই হাজার টাকার প্রশিক্ষণসামগ্রী কেনা।
সেই প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রতিমন্ত্রী বা মন্ত্রী মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে জানা যায়নি। অর্থাৎ এত বড় অন্যায়কে তাঁরা মেনে নিয়েছেন। আর প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশ অনুযায়ী চাকরি দেওয়া হলে হয়তো মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে কোনো চিঠিও তিনি লিখতেন না দুদকের চেয়ারম্যানের কাছে।
তাহলে ফলটি দাঁড়াল, তুমি যেহেতু দুর্নীতি করেছ, আমার তালিকা অনুযায়ী প্রার্থীদের চাকরিও দিতে হবে। এই আবদার স্বাস্থ্য মহাপরিচালক শোনেননি বলেই বেকায়দায় পড়েছেন। অর্থাৎ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চুরির ঘটনা তখনই ধরা পড়ে, যখন চোরে চোরে মাসতুতো ভাই থাকেন না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.