পদ্মা সেতু ॥ দরপত্র আহ্বান- ০ ৯ সেপ্টেম্বর জমা দেয়ার শেষ দিন- ০ মূল সেতু নির্মাণে ৯১৭২ কোটি টাকার দরপত্র- ০ বিশ্বব্যাংকসহ সকল উন্নয়ন সহযোগীর পরামর্শ মানা হবে

অবশেষে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। মূল সেতু নির্মাণে ৯ হাজার ১৭২ কোটি টাকার এ দরপত্র বুধবার সেতু বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
প্রকল্প পরিচালক মোঃ সফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত মূল সেতুর দরপত্রে বলা হয়েছে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর বিকেল তিনটার মধ্যেই দরপত্র দাখিল করতে হবে। ওই দিন বিকেল সাড়ে ৩টায় দরদাতাদের উপস্থিতিতে (যদি কেউ উপস্থিত থাকেন) দরপত্র খোলা হবে।
এ দরপত্র আহ্বানের মধ্যদিয়ে দীর্ঘ দিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে এ সেতুটি বাস্তবায়নের পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও পূরণ হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণেই প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। সকালে সচিবালয়ে চীনের পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার ফেং ঝেংলিনের সঙ্গে এক বৈঠকের পর তিনি এ কথা জানান। পদ্মা সেতু নির্মাণে চীন থেকে আর্থিক সহায়তা চাওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এ ধরনের কোন প্রস্তাব দেয়া হয়নি। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো অর্থ সরকারের হাতে আছে।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে এবং রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলা সড়কপথে সরাসরি যুক্ত হবে। পাশাপাশি আঞ্চলিক বৈষম্য কমে ওই অঞ্চলের জীবনমানে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
ইতোমধ্যেই পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য কয়েকদিনের মধ্যে শুরু হতে যাওয়া (২০১৩-১৪) অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) ৬ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৫ হাজার ২৫২ কোটি এবং ভারতীয় অনুদান থেকে এক হাজার ৬শ’ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। যা চলতি অর্থবছরে (২০১২-১৩) এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৮০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সাহায্য ছিল ৫৭২ কোটি টাকা। তবে জুলাই থেকে নবেম্বর পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে ৪৩ কোটি ২ লাখ টাকা। এ অবস্থায় সংশোধিত এডিপিতে পদ্মা সেতুর বরাদ্দ ৭০০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি ও জাইকা থেকে ১০৫ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। অন্যদিকে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পে ইতোমধ্যে সর্বমোট ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২৫৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ১৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে উন্নয়ন সহায়তার অংশ থেকে।
এ প্রকল্পের জন্য শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও মুন্সীগঞ্জে মোট দুই হাজার ৪৫২ একর জমি অধিগ্রহণ এবং ২৬০ একর জমি হুকুম দখল করা হয়েছে। জমির দাম বাবদ ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়া হচ্ছে প্রায় এক হাজার ১৪ কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, ভারতীয় অনুদানের দু’টি কিস্তি ইতোমধ্যেই ছাড় হয়েছে। বাকি দুই কিস্তিতে আরও ১০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে। এ অর্থ ব্যয় করা হবে। এ বিষয়ে ইআরডির যুগ্ম সচিব আসিফ-উজ-জামান বলেন, ভারতের পক্ষে জানানো হয়েছে অনুদানের অর্থ যে কোন খাতে ব্যয় করা যাবে। সেতু প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ে আপত্তি নেই দেশটির।
এর আগে জাতীয় সংসদে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, নিজস্ব অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন শুরু করেছি। এটিই একমাত্র উপায় বলে আমার মনে হয়। জাজিরা সংযোগ সড়ক ও সংশ্লিষ্ট নদী শাসনের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। মাওয়া ও জাজিরা নির্মাণ ঘাঁটি স্থাপন এবং মাওয়া সংযোগ সড়কের ক্রয় প্রস্তাব অচিরেই নির্দিষ্ট হবে। তিনি জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল সেতু নদী শাসনের কাজটি সারাবিশ্বে শুধুমাত্র কয়েকজন ঠিকাদারই করতে সক্ষম। এজন্য পূর্ব নির্ধারিত ওইসব ঠিকাদারকে প্রস্তাব অতিসত্বরই আহ্বান করা হচ্ছে। এ দুই কাজের চুক্তি সম্পাদন বর্তমান সরকারের মেয়াদকালেই করা সম্ভব হবে বলে তিনি জানিয়েছিলেন।
সেতুর ব্যয় প্রসঙ্গে যোগাযোগমন্ত্রী এর আগে জানিয়েছিলেন, নদী শাসন, মাওয়া ও জাজিরা এপ্রোচ রোড, সার্ভিস এরিয়া, পুনর্বাসন, সুপারভিশন কনসালটেন্ট, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড, টোল প্লাজা, ভূমি অধিগ্রহণসহ পদ্মা সেতু প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াবে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু নির্মাণে ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি হলেও পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিষয়টি ঝুলে যায়। দীর্ঘ টানাপড়েন শেষে চলতি বছর জানুয়ারিতে সরকার বিশ্ব ব্যাংককের অর্থায়ন ‘না’ বলে দেয়। সে সময় এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯০ কোটি ডলার। এর সঙ্গে অন্য দাতা সংস্থা এডিবি, জাইকা এবং আইডিবিও পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে যায়। বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় সরকার। চীন ও মালয়েশিয়া সেতু নির্মাণ করে দেয়ার বিষয়ে আলাদা বিনিয়োগ প্রস্তাব দিলেও সেগুলো সরকারের সায় পায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে নিরাপত্তা ও তদারকির জন্য সেনাবাহিনীর একটি ‘কম্পোজিট ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.