গ্রাম জিতবে কবে by অমিত বসু

ফুটবল দিয়ে টেবিল টেনিস হয় না। পিংপং বল লাগে। বড় হলেই সব জায়গায় রাজত্ব সম্ভব নয়। মাপটা মনে রাখা জরুরি। সাদা ছোট্ট বলটা টেবিলে ঝড় তোলে। ফুটবল বা বাস্কেটবল সেখানে দাপাতে গেলে টেবিলটাই ভাঙবে।
খেলার পাল ছিঁড়বে। নস্যাৎ হবে আসর। সেটাই হচ্ছে গ্রাম পঞ্চায়েতে। ছোট্ট এলাকার সামান্য নির্বাচন। সপরিবার সুখে বাঁচতে সদস্যদের, পরিবার কর্তা ঠিক করা। যে দেখবে কার কতটুকু দরকার। ঠিক প্রয়োজনটা কী। বাইরের হেভিওয়েট নেতারা সেটা বোঝে না, বুঝতে চায়ও না। তাদের কেবল দখলদারির নেশা। সংখ্যায় সাফল্য বিচার। আমরা কিছু করছি না, ওরাই সবকিছু করছে বলে সবেতে নাক গলায়। কাছের লোক নিজের লোককে প্রার্থী করতে ব্যতিব্যস্ত। হারলে পস্তাতে হবে ভেবে অযথা মাতব্বরি। পদে পদে খবরদারি। তার থেকে মারামারি, কাটাকাটি, রক্তারক্তি। গ্রামের সরল ফ্যামিলিগুলো রসাতলে। দাপুটে নেতাদের অসৌজন্য দেখে মৌন।
মাস্তানদের এমনি কেউ মানে না, মানাতে হয়। উচ্চকিত কণ্ঠে জানিয়ে দিতে হয়, আমাকে মানলে সব পাবে, নইলে কচুপোড়া। গাঁয়ে না মানলেও তারা নিজেরাই মোড়ল। তাদের মুখের ওপর কথা বলার হিম্মত কার। তারা যত বলে, এতে আপনার ভালো হবে। মাছ চাষ বাড়বে, ঘরে বাড়তি টাকা উঠবে, তত সংকুচিত হয় পুকুর কর্তারা। সবিনয়ে বলে, আমাদের ভালয় কাজ নেই। দয়া করে পুকুরের দিকে নজর দেবেন না। যদি সত্যি ভালো চান, জলে ফলিডন দিয়ে মাছ মারা বন্ধ করুন। মাছ বাড়তে পারছে না। বড় হওয়ার আগেই বিষ মিশিয়ে মারা হচ্ছে। মাছ চাষ শিকেয় উঠছে। মৎস্য ঘাতকদের চেনেন আপনারা। তাদের কড়া শাস্তি দিয়ে এ কাজ থেকে বিরত করুন। যদি পারেন আমরা কৃতার্থ হবো। আপনারা রক্ষক, না ভক্ষক বুঝতে পারছি না।
গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচিত সরকারি সংস্থা। নিঃশর্তে মানবসেবাই তাদের কাজ। দলমত নির্বিশেষে সবাই পরিসেবার আওতায় আসবে। বাছবিচার চলবে না। কেউ বলতে পারবে না, ও পেল, আমি পেলাম না। ভুলেও পঞ্চায়েত কর্মীকে কেউ বলবে না, আমি আপনাদের বিশ্বাস করি না। বিশ্বাসযোগ্যতা সব সংস্থারই প্রধান মূলধন। সেটা না থাকলে মানুষ মরবে। গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হবে গ্রাম পঞ্চায়েত।
অথচ এটাই গণতন্ত্রের শিকড়। জনসাধারণের প্রত্যক্ষ অংশীদারিত্ব এতেই। নিজেরাই নিজেদের গ্রাম গড়বে। উন্নয়নের ডানায় ভর করে উড়তে উড়তে বলবে, আমাদের জন্য ভেব না, আমরা ভালো আছি।
আগে মোড়লরা মোড়লি করত গ্রামে। ৩৪ বছরে বামফ্রন্টের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব পঞ্চায়েত নির্বাচন চালু করা। ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসে তারা ১৯৭৮-এ ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করে। সারাদেশ চমকে যায়। গ্রামের মানুষ নিজেদের গ্রাম নিজেরাই চালাবে, সেটা সত্যি, না স্বপ্ন। বিদেশ থেকে প্রতিনিধিরা আসতে শুরু করে পঞ্চায়েতের কাজকর্ম দেখতে। বাংলাদেশের মানুষরা দেখেশুনে বলত, নিঃস্ব মানুষরা উন্নয়নের সর্বময় কর্তা। এ তো তাজ্জব ব্যাপার। আর ভূমি সংস্কার সে তো তাজমহলের চেয়ে বিস্ময়কর।
তার দৌলতেই কষি আর মৎস্য উৎপাদনের প্রথম সারিতে পশ্চিমবঙ্গ। পড়াশোনায় গ্রামের ছেলেমেয়েরা শীর্ষে। শহর হেরেছে। শুধু মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এক লাখ থেকে বেড়ে দশ লাখ অতিক্রান্ত। ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও গ্রামের লোকেরা আজ শহরে আসে না। সংকট নিজেরাই সামলে নেয়। যারা শহরে পরিচারিকার কাজ করতে আসত, তারাও কলকাতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্বনির্ভর হয়েছে।
১৯৯৩ থেকে ভূমি সংস্কারের সুফল পনের বছর ছিল। চাহিদার ধরন পাল্টাতে থাকে। ভিন্ন অর্থনৈতিক বিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নতুন উপভোক্তা শ্রেণী গ্রামীণ মূল্যবোধকে অস্বীকার করে আরও পাওয়ার আশায় হাত বাড়ায়। লোভের চাপে সংহতির চেয়ে স্বার্থপরতা বড় হয়ে দাঁড়ায়। তার প্রভাবে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থায় বেনোজল ঢুকতে থাকে। অর্থ আর ক্ষমতার অহঙ্কার জনপ্রতিনিধিদের মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকে।
এখন তার চূড়ান্ত পরিণতি দেখা যাচ্ছে। নিরাপত্তা নিয়ে সংশয়। রক্তপাতশূন্য গ্রাম খুবই কম। সমাজবিরোধীরা আশ্রয় পাচ্ছে রাজনীতিতে। যে কোনো হিংসা থেকে ধর্ষণ তাদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়। সব লজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে কেবল পেশিশক্তিতে ছড়ি ঘোরাতে চাইছে।
এই যদি অবস্থা হয় তাহলে গ্রাম পঞ্চায়েতের দরকার কী। তারা যদি গ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে উন্নয়নের পথ দেখাতে না পারে এত সুন্দর সিস্টেমটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। গ্রাম পঞ্চায়েতের ওপর পঞ্চায়েত সমিতি, তার মাথায় জেলা পরিষদ। গ্রাম পঞ্চায়েত ভিত। সেটা ভাঙলে সব হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। অসুররা সেটাই চাইছে। সব ঘেঁটেঘুঁটে দে মা, লুটেপুটে খাই। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহাকাব্য 'বৃত্রসংহার'-এ একই অবস্থা হয়েছিল। বৃত্রাসুরের কবলে পড়ে স্বর্গরাজ্যে চূড়ান্ত নৈরাজ্য। অসহায় দেবরাজ ইন্দ্র। তার সব অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধ কৌশল ব্যর্থ। বাধ্য হয়ে তিনি মরেছেন অসুরের হাতে। পত্নী শচীর লাঞ্ছনা। অন্যদিকে বৃত্র আর স্ত্রী ঐন্দ্রিলার স্থূল দাম্পত্য প্রেম দেখে তিনি মানসিকভাবে পীড়িত। ইন্দ্রের সব ক্যারিশমা পুড়ে ছাই। অবশেষে ইন্দ্র দধীচির শরণাপন্ন। তার অস্থি দিয়ে নির্মিত বজ্রেই বৃত্রাসুরের পতন। আজ গ্রাম যতটুকু আলো দেখেছে এই দধীচিদের কল্যাণে। আজও তারা আছেন। সব দেখছেন, শুনছেন, কিছু করতে পারছেন না। পথ আটকে রেখেছে অসুররা। তাদের সামনে আনতে হবে। চিরন্তন নির্মাণ বরাবরই বৃহৎ আত্মত্যাগের ওপর নির্ভরশীল।
স ভারতীয় সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.