ম্যান্ডেলার অবর্তমানে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

১৯৯৩ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ক্রিস হানি শ্বেতাঙ্গ আততায়ীর হামলায় নিহত হন। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কর্মীসহ সাধারণ মানুষকেও এ হত্যাকাণ্ড বড় ধরনের নাড়া দেয়।
ডাক ওঠে প্রতিশোধের। বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গায় ৭০ জনেরও বেশি মারা যায়। গৃহযুদ্ধের কালো মেঘ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। তবে বিপর্যয় সামলাতে এগিয়ে আসেন নেলসন ম্যান্ডেলা। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান। 'সবার জন্য স্বাধীনতা'- এ লক্ষ্য অর্জনে হানি যেখানে প্রাণ দিয়েছেন, সেখানে দেশবাসীকে সহনশীলতা দেখানোর ডাক দেন। সহিংসতা এড়াতেই দেশটির শ্বেতাঙ্গ সরকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পক্ষের প্রধান রাজনৈতিক দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছায়। এরই অংশ হিসেবে ১৯৯৪ সালে সব গোষ্ঠীর অংশগ্রহণে নির্বাচন হয় এবং ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বড় ধরনের রক্তপাত এড়িয়ে ক্ষমতার পালাবদলের কারণে বিশ্ববাসী দক্ষিণ আফ্রিকাকে 'বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত' হিসেবে আখ্যায়িত করে।
তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ২০ বছর পর সেই দক্ষিণ আফ্রিকা আজ 'মরীচিকায়' রূপান্তরিত হয়েছে। দুর্নীতি, বেকারত্ব, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, অপরাধ দেশটিকে জর্জরিত করে ফেলেছে। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সুবাদে যে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্তের জায়গা নিয়েছিল, সেই দেশটিই আবরও বর্ণবাদের থাবায় পড়তে যাচ্ছে। ১৯৯৯ সালের পর থেকে রাজনীতি থেকে দূরে নিভৃত জীবন কাটাচ্ছিলেন ম্যান্ডেলা। এর পরও জাতির সংকটের সময়গুলোতে তাঁর কাছেই আশ্রয় খুঁজেছে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ। ম্যান্ডেলার অবর্তমানে তাদের মানসিক প্রশান্তিটুকুও হারিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী নেতা হিসেবে দেশ চালিয়েছেন ম্যান্ডেলা। ক্ষমতায় আসার পর বর্ণবাদের অবসান থেকে শুরু করে সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য, ঐক্য প্রতিষ্ঠার মতো বেশির ভাগ অঙ্গীকার পূরণে ম্যান্ডেলা অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত রাখেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের শাসনে দক্ষিণ আফ্রিকাকে তিনি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। দারিদ্র্য দূরীকরণ, ভূমি সংস্কার ও স্বাস্থ্যসেবার পরিসর বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন। অতীতের সরকারগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের জন্য বিশেষ কমিশন গঠন করেন। এইচআইভি ও এইডসের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশন গঠন করেন।
দেশে ও বাইরে প্রভাব সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে অনীহা প্রকাশ করেন। তবে অবসরে চলে গেলেও দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমান প্রজন্মের কাছে ম্যান্ডেলার আকর্ষণ কমেনি এতটুকুও। তাদের কাছে তিনি আফ্রিকান আত্মমর্যাদা, নৃতাত্তি্বক সম্প্রীতি, দলীয় ঐক্য, দিকনির্দেশক ও সততার প্রতীক হয়ে আছেন। ২৭ বছর কারাগারে থাকার পরও আদর্শচ্যুত না হওয়ার নীতিতে অটল ও নিঃস্বার্থ থাকার যে নজির তিনি স্থাপন করেছেন, আফ্রিকাসহ পুরো বিশ্বের মানুষ তা থেকে অনুপ্রেরণা খোঁজে।
ম্যান্ডেলার স্বাস্থ্য নিয়ে জনগণের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অবর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থান নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা এখন কার্যত প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। শ্বেতাঙ্গরা অর্থনীতির প্রধান খাতগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এর সুবিধাগুলো আঁকড়ে রেখেছে। উন্নত শিক্ষাদীক্ষা ও অত্যাধুনিক জীবনযাপনে তারা আরো এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গ ধনিক শ্রেণীও রয়েছে। তবে তারা সংখ্যায় কম। কৃষ্ণাঙ্গদের বড় একটি অংশই সামাজিক সুবিধাবঞ্চিত ও দারিদ্র্যকবলিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। দেশটিতে বেকারত্ব ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট বাড়ছে। অপরাধের মাত্রা ও এইচআইভির সংক্রমণ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। বর্ণবাদী সহিংসতা অধঃপতনের নতুন শঙ্কা তৈরি করেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অভিবাসী ও পর্যটকদের ওপর হামলাও বেড়েছে। ক্ষমতাসীন দল এএনসিতে কোন্দল তৈরি হয়েছে। ম্যান্ডেলার অর্জন ও তাঁর আদর্শ আরো আগে থেকেই হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। মাথার ওপর থেকে 'ম্যান্ডেলা-বৃক্ষের' ছায়া সরে গেলে জনগণ তাদের মানসিক আশ্রয়টুকুও হারাবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.