সীমান্তে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ চাই by রউফুল আলম

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের সম্পর্ক চার দশকেরও বেশি। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের সহযোগিতা এই সম্পর্কের ভিত গড়ে তোলে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সরকারের এই অবদান এ দেশের গণমানুষ ও প্রতিটি সরকার কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই স্মরণ করেছে এবং এখনও করছে।
স্বাধীনতা-উত্তর দুই দেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে বাংলাদেশ বারবারই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে, কিন্তু পারমাণবিক শক্তিধর ভারতের কূটনৈতিক আচরণ বন্ধুত্বপূর্ণ থাকেনি, বরং কখনও কখনও তা ঔদ্ধত্যপূর্ণই ছিল। গত চার দশকে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বহু বিষয়ের মধ্যে সীমান্তে হত্যার বিষয়টি অন্যতম। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) নিছক স্বেচ্ছাচারিতার কারণে দিনের পর দিন বাংলাদেশি মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এ বছরের শুরুতেই সীমান্তে চারজন নিরপরাধ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে বিএসএফ। প্রতি মাসেই বিচ্ছিন্নভাবে এমন হত্যার ঘটনা পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। এ মাসের ১২ তারিখ বেনাপোল সীমান্তের পুটখালী এলাকায় দু'জন বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়। সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গার হরিহরনগর সীমান্তে পুনরায় আরও একজনকে হত্যার খবর নিশ্চিত করে বিজিবি। অব্যাহতভাবে সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে মানুষ খুন করা আন্তর্জাতিক অপরাধেরই সমতুল্য। বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার'-এর জরিপ অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন সীমান্তে মোট ৯৯৮ জন বাংলাদেশি নিহত হয়। শুধু বিএসএফ ৯২৩ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের ত্রিসীমানার সঙ্গে ভারতের সুদীর্ঘ সীমারেখা প্রায় চার হাজার কিলোমিটার। স্বাভাবিকভাবেই সীমান্ত ঘেঁষে আছে বহু মানুষের বসতি। বিএসএফ যেভাবে আগ্রাসী আচরণ করছে তাতে সীমান্তের মানুষদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই বিভীষিকাময় জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি ফেলানী নামে এক তরুণীকে হত্যা করে সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনায় বিএসএফের নৃশংস মানসিকতার প্রকাশ পায়, যা এ দেশের মানুষকে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ করে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বিপুল সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর দু'দেশের সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে র্দীঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান হবে বলেই আশা করেছিল এ দেশের মানুষ। ২০১০ ও ২০১১ সালে দু'দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকও হলো দিলি্ল ও ঢাকায়। ভারতের বিভিন্ন মহলের ধারাবাহিক প্রতিশ্রুতির পরও সীমান্তে হত্যার এমন ঘটনা ন্যক্কারজনক। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে গত চার দশকে কত বাংলাদেশি মেরেছে বিএসএফ, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। আমাদের একটি সরকারও এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত যায়নি। আমরা মৌখিক আশ্বাসেই চুপ করে থাকি। ভারত যদি প্রতিনিয়ত সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে আগ্রাসী মনোভাবই প্রকাশ করে, তাহলে আমাদের আন্তর্জাতিক সাহায্য নিতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে ক্রমাগত শক্তিশালী ভারত, দক্ষিণ এশীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে মরিয়া হয়ে উঠছে দিন দিন।
সরকারের লক্ষ্য রাখা উচিত, সীমান্তে হত্যার বিষয় এ দেশের মানুষের জন্য খুবই স্পর্শকাতর। সীমান্তে হত্যার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কোনো নমনীয়তা দেখানো উচিত নয়। টিপাইমুখে বাঁধ, গঙ্গার পানি বণ্টন, করিডোর ও ছিটমহল, দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ, কাঁটাতারের বেড়া, তিস্তার পানি বণ্টন এবং সীমান্তে হত্যা ইত্যাদি বহু বিষয় নিষ্পত্তিতে ভারতের আচরণ সময়ে সময়ে এ দেশের মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
সুতরাং দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত দ্বিপক্ষীয়ভাবে এবং প্রয়োজনবোধে আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে এগুলো সুষ্ঠু মীমাংসা করা। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রের স্বার্থে পররাষ্ট্রনীতিতে ঐকমত্য থাকতে হবে। উন্নত দেশের রাজনীতি থেকে এই শিক্ষাটুকু আমাদের রাজনীতিকরা যেন গ্রহণ করেন।
ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ। আমাদের স্বার্থেই তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। বড় দেশ হিসেবে ভারতের প্রতি অনুরোধ, দু'দেশের সম্পর্ক উত্তরোত্তর ঘনিষ্ঠ করার স্বার্থেই সীমান্তে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করুন।

স রউফুল আলম : ডক্টরাল গবেষক
স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন

No comments

Powered by Blogger.