ওহ্! ম্যান্ডেলা'মাদিবা' এখন জীবন্মৃত

‘তুমি আমাদের সত্যিকারের লিজেন্ড ও টাটা (পিতা) হিসেবে আছ এবং থাকবে পৃথিবী যত দিন আছে।’ একটি সাদা পুতুল ভালুকের গলায় ঝোলানো এক চিঠিতে এই বাক্য লেখা। দেয়ালে সাঁটানো আরেকটি চিঠিতে লেখা, ‘টাটা ম্যান্ডেলা, তুমি ছাড়া পৃথিবী সুন্দর হবে না।’
এ রকম আবেগমথিত বহু বাক্যসংবলিত চিঠি, পোস্টার, নানা রঙের ফুল আর বেলুনে ছেয়ে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ার মেডিক্লিনিক হার্ট হসপিটালের প্রাঙ্গণ। এই হাসপাতালেই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নায়ক ও দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা। তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে মৃত ঘোষণা করা হতে পারে কিংবদন্তির এই মহান নেতাকে।
শুধু দক্ষিণ আফ্রিকারই নয়, সারা বিশ্বের অগণিত মানুষ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে কান পেতে আছে ৯৪ বছর বয়সী প্রিয় এই নেতার দিকে। তাঁর পাশে রয়েছেন স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠজনরা। আর তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে চোখে জল, হাতে ফুল, চিঠি ও পোস্টার নিয়ে কয়েক দিন ধরেই ভক্তরা ভিড় করছে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে। গতকাল বুধবার সকাল থেকে সেই ভিড় আরো বাড়তে থাকে। অগণিত ভক্তের হাহাকার, প্রার্থনা আর তাঁকে নিবেদিত বিষাদময় গানের মুহুর্মুহু ব্যঞ্জনায় সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন পরিবেশের। ম্যান্ডেলার ‘চূড়ান্ত প্রস্থান’ যেন শান্তিপূর্ণ হয়- এই প্রার্থনা করতে দেশবাসীসহ সবার প্রতি আহবান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা।
হাসপাতাল সূত্রের বরাত দিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যম গতকাল জানায়, দক্ষিণ আফ্রিকার গণতন্ত্রের জনক প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলাকে মুমূর্ষু অবস্থায় ভেন্টিলেশনে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। তাঁর কিডনিসহ অন্য অনেক অঙ্গ ঠিকমতো সাড়া দিচ্ছে না। দিনে দুইবার তাঁর ডায়ালিসিস করানো হচ্ছে। তাঁকে সুস্থ করে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল। তবে এই লড়াইয়ে ম্যান্ডেলা হেরে যেতে বসেছেন- এমন আশঙ্কা করছে তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা। তাঁকে ‘সশ্রদ্ধ বিদায়’ জানানোর প্রস্তুতিও এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
এদিকে কেপ টাউনের আর্চবিশপ থাবো মাকগোভা মঙ্গলবার ম্যান্ডেলাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান এবং বিশেষ প্রার্থনা করেন। প্রার্থনায় তিনি বলেন, ‘মাদিবা (ম্যান্ডেলার গোত্রের দেওয়া নাম) যে যন্ত্রণা ভোগ করছেন, তা থেকে তিনি যেন দ্রুত মুক্তি লাভ করেন। তাঁর বিদায়ের মুহূর্তটিও যেন হয় শান্তিপূর্ণ।’ সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন এক সময়।’ দেশটির শীর্ষস্থানীয় যাজকরাও প্রার্থনায় বসেছেন ম্যান্ডেলার জন্য।
নিউমোনিয়া থেকে ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা দেওয়ায় গত ৮ জুন প্রিটোরিয়ার মেডিক্লিনিক হার্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ম্যান্ডেলাকে। চলতি বছর এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো তাঁকে ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে। গত রবিবার থেকে তাঁর অবস্থার অবনতি হওয়ায় হাসপাতালে জড়ো হতে শুরু করে তাঁর পরিবারের সদস্যরা। ওই দিনই হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যান দেশটির প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা।
গত সোমবার জুমা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পাই, মাদিবা (ম্যান্ডেলা) ঘুমে। চিকিৎসক ও মাদিবার স্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মাদিবার বয়স হয়েছে, এটা সবার মনে রাখতে হবে। বয়সের কারণে তাঁর শারীরিক সমস্যা হবে। আমার মতে, এ মুহূর্তে আমাদের উচিত তাঁর জন্য প্রার্থনা করা।’
মঙ্গলবার প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ম্যাক মহারাজ জানান, ম্যান্ডেলার অবস্থা সংকটাপন্ন। তাঁর জন্য দেশবাসীকে প্রার্থনা করার আহবান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট।
এ বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানতে সাংবাদিকরা প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ম্যাক মহারাজের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে গতকাল তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
হাসপাতালে ম্যান্ডেলার পাশে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী গ্রাসা মেশেল, সাবেক স্ত্রী উইনি মাডিকিজেলা ম্যান্ডেলা, মেয়ে মাকাজিউয়ি, জিনজি ম্যান্ডেলা, জিনানি ম্যান্ডেলাসহ পরিবারের সদস্য ও দেশটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। তবে গণমাধ্যমকর্মীদের হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পুলিশের কঠোর নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়েছে হাসপাতালের সামনের রাস্তায়।
এদিকে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ওই হাসপাতালে ম্যান্ডেলার পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠজনদের ছুটে যাওয়া, ঘরোয়া বৈঠক করা এবং কুনু গ্রামে তাঁর বাড়িতে সমাধিস্থলে কবর খোঁড়ার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি প্রস্তুত রাখার বিষয়টি থেকে ধারণা করা হচ্ছে, হয়তো জীবনের শেষ মুহূর্তে পৌঁছে গেছেন তিনি। যেকোনো মুহূর্তে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হতে পারে। এ ছাড়া ম্যান্ডেলার ওই বাড়িতে গতকাল পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।
ম্যান্ডেলার নিজ গোষ্ঠী আবা থেম্বুর প্রবীণদের একটি দল গতকাল হাসপাতালে গিয়ে তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিয়ে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল বলে বার্তা সংস্থা টাইমস জানিয়েছে।
নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার থেম্বু রাজবংশের ক্যাডেট শাখায়। কালো মানুষদের অধিকারের পক্ষে আন্দোলনের কারণে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে স্নাতক ম্যান্ডেলাকে তারুণ্যের ২৭টি বছর কাটাতে হয়েছে কারাগারে। ওই সময় উন্মুক্ত খনিতে কাজ করার সময় তাঁর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ব্যক্তিজীবনে পর্যায়ক্রমে তিনজন নারীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। দুই ছেলে ও তিন মেয়েসন্তানের জনক বর্ণবাদবিরোধী এই নেতা।
১৯৯০ সালের ১১ ফেব্র“য়ারি মুক্তি পাওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ম্যান্ডেলা। দেশটির শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গনির্বিশেষে সবাইকে একই ছাতার নিচে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকার ‘গণতন্ত্রের জনক’ আখ্যায়িত করা হয়। বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য ম্যান্ডেলাকে ১৯৯৩ সালে এফ ডাব্লিউ ডি ক্লার্কের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ছাড়া শাখারভ পুরস্কারসহ ২৫০টির বেশি পুরস্কার লাভ করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.