কথা সামান্যই-কম্পিউটারের যুগে শিক্ষা by ফজলুল আলম

যারা কম্পিউটারের ম্যাজিক দেখে মুগ্ধ, আমিও তাদের মধ্যে একজন। প্রতিটি ঘরে একটি করে কম্পিউটার থাকবে ইন্টারনেট কানেকশনসহ_এটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাতে তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা ও জ্ঞানের ভাণ্ডারে প্রবেশ করা আর কোনো সমস্যা হবে না।
এ ধারণার কথা ভাবলেই আমার মনে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সফল গাড়ি তৈরি করা শিল্পপতি হেনরি ফোর্ডের কথা মনে পড়ে। একপর্যায়ে তিনি ছোট আকারের সহজলভ্য গাড়ি তৈরি শুরু করে গর্ব করে বলেছিলেন যে তিনি দেখতে চান, দেশের প্রতিটি শ্রমিক-কর্মী একটা করে গাড়ি রাখবে এবং তাতে দারিদ্র্য আর থাকবে না। এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও অনেক উন্নত অর্থনীতির দেশে প্রতিটি শ্রমিকের (এমনকি বেকার থাকলেও) একটি নয়, একটির বেশি গাড়ি আছে। হেনরি ফোর্ডের স্বপ্ন অর্ধেক বাস্তবায়িত হয়েছে, কিন্তু বাকি অর্ধেকের সমস্যা যায়নি। এসব ধনী দেশে দরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা ওঠানামা করতে করতে এখন বৃদ্ধির দিকে। হেনরি ফোর্ড জানতেন না, দারিদ্র্যের কারণ গাড়ি না থাকা নয়, দারিদ্র্য পুঁজিবাদের সঙ্গে জড়িত একটি প্রয়োজন। গাড়ির বা ভোগ্যপণ্যের মালিকানা অর্জন করার সঙ্গে দরিদ্র হয়ে থাকা বা না থাকার কোনো সম্পর্ক এভাবে স্থাপন করা যায় না।
শুরু করলাম কম্পিউটার নিয়ে; কিন্তু চলে গেলাম ফোর্ডিস্ট যুগের ধারণায়। তার কারণ আছে অবশ্যই। অনেকে মনে করেন, আমাদের যা যা প্রয়োজন আছে, সবই আমি কম্পিউটার থেকে পেতে পারি। বাস্তবে কম্পিউটার যখন তৈরি হয়, তখন প্রোগ্রামিংয়ের সফটওয়্যার ছাড়া তার স্মৃতিতে আর কিছু থাকে না। এমনকি অনেক কম্পানি তাদের কম্পিউটারে 'মাইক্রোসফট অফিস' জাতীয় প্রোগ্রামও দিয়ে দেয় না। ক্রেতা চাইলে সেসব ইনস্টল করে দেয়, অথবা ক্রেতা নিজেই ইনস্টল করে নেয় (পয়সার ব্যাপার তো আছেই)। তারপর আসে ইন্টারনেট। সাধারণত আমরা ভাবি, ইন্টারনেট স্যাটেলাইটে কে বা কারা তৈরি করে রেখেছে এবং আমরা আমাদের প্রয়োজনমতো সেখান থেকে যা প্রয়োজন তা ডাউনলোড করে নেব। আরেক বিস্ময়কর সৃষ্টি সার্চ ইঞ্জিন। ইন্টারনেটের আসল অর্থ হলো, অনেক কম্পিউটারের একে অপরের সঙ্গে নেটওয়ার্কের নেটওয়ার্ক এবং সেটা সম্ভব হয়েছে স্যাটেলাইট প্রযুক্তির জন্য। এই কম্পিউটারগুলোতে রাখা তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে থাকে এবং তাদের ইচ্ছামতো তথ্যগুলো পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা বিলুপ্তিকরণ_সবই করা যায়। ইন্টারনেটের অবিশ্বাস্য অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় পাল্লা দিয়েই কম্পিউটার টেকনোলজিতেও অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে। ডিজিটাল টেকনোলজিতে আইবিএম অপারেটিং সিস্টেমভিত্তিক কম্পিউটার ৩২ থেকে ৬৪ বিটে (বাইনারি ডিজিটে) চলত, এখন সবচেয়ে স্বল্প দামি কম্পিউটারে ডাবল বা ট্রিপল বিটে কাজ হয়। অন্যদিকে ম্যাকিনটশ বা অ্যাপল কম্পিউটার সম্পূর্ণ ভিন্ন অপারেটিং প্রক্রিয়ায় চলে এবং সেটায় বিটের সংকীর্ণতা প্রযোজ্য হয় না।
এসব কথা এখানে বলার উদ্দেশ্য যে কম্পিউটার এখন হেন কাজ নেই, যা করতে পারে না। সেই কারণে অনেক কম্পিউটারপ্রেমিক মনে করেন, ভবিষ্যতে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়_কোথাও গিয়ে আর পড়াশোনার প্রয়োজন হবে না; মৌলিক বুনিয়াদি শিক্ষা থেকে শুরু করে সব কিছু কম্পিউটারের মাধ্যমেই বাসায় বসে করা যাবে (তাঁরা আবার উদাহরণ দেন যে পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত দেশে অফিসে না গিয়েও বাসায় বসে কম্পিউটার মারফত অফিসের সব কাজ করে দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু হয়ে গেছে)। উত্তম কথা, কিন্তু হেনরি ফোর্ডের প্রত্যাশার সঙ্গে শিক্ষার ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ওপর সব কিছু ছেড়ে দেওয়ার একটা মিল আছে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে কম্পিউটার নতুনভাবে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, শব্দ, বাক্য, ব্যাকরণ, সংখ্যা, নামতা, অঙ্ক ইত্যাদি শেখাতে সক্ষম হয়ে উঠেছে (যেমন_বিদেশি ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে) এবং মৌলিক শিক্ষা কম্পিউটার মারফত পাওয়া সম্ভব। এসব আরো অনেক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। কম্পিউটারের মাধ্যমে শিক্ষণীয় বিষয় অবশ্যই শেখা যাবে। কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক এই শিক্ষার মধ্য থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। যেসব ছেলেমেয়ের শিক্ষা কম্পিউটারের মাধ্যমে শুরু হবে, তারা যে শিক্ষা পাবে, তা থেকে তারা অক্ষর চিনবে, শব্দ চিনবে, অঙ্ক শিখবে; কিন্তু তারা কি সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত হতে পারবে?
শিক্ষা যদি শুধু অক্ষর চেনা, অঙ্ক করা আর পড়ালেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ বিষয় হতো তাহলে কম্পিউটার অবশ্য পূর্ণ কাজটাই করতে পারত। কিন্তু শিক্ষিত হওয়ার অর্থ এত সংকীর্ণ নয়। মানুষ সমাজে বসবাস করে, ছেলেমেয়েরা অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে, তাদের মা-বাবার সঙ্গে, শিক্ষকদের সঙ্গে, খেলাধুলায়, তর্ক-বিতর্কে, বাইরের জগতের পরিবেশে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে শিক্ষা অর্জন করে, তা বইয়ের (কম্পিউটার তো বইয়ের শিক্ষাই যন্ত্রের মাধ্যমে দেয়) শিক্ষার মধ্য দিয়ে আসে না। এমনকি উচ্চশিক্ষাকালে কম্পিউটার যতই অপরিহার্য হচ্ছে, সে সময়ও ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়িত না হলে উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। শুধু কম্পিউটার মারফত শিক্ষা কখনোই পূর্ণ শিক্ষা হবে না।
হেনরি ফোর্ড দারিদ্র্য দূর করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, কারণ তিনি দারিদ্র্যের উৎস কোথায় জানতেন না_গাড়ি বা টাকা পেলেই যে গরিব ধনীতে পরিণত হয়ে যাবে, তা বাতুল চিন্তা। শিক্ষার ক্ষেত্রেও আমরা একই যুক্তি প্রয়োগ করতে পারি। শিক্ষিত হতে গেলে অনেক বড় পরিসরে ও বড় পরিমণ্ডলে 'জ্ঞান' অর্জন করার প্রয়োজন হয়। কম্পিউটার তথ্য ও বইয়ে যা লেখা আছে, তা নিমেষে আমাদের কাছে হাজির করতে পারে; কিন্তু জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া সেভাবে কার্যকর হয় না।
তবে একটা কথা শেষে বলতে বাধ্য হচ্ছি, বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষাকে বাণিজ্য হিসেবে নেওয়ার যে প্রতিযোগিতা, তা শিক্ষিত মানুষ সৃষ্টি হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে বা বৃদ্ধি পায়, তাহলে কম্পিউটারের মাধ্যমে 'যান্ত্রিক' মানুষ তৈরি করাতে আমি আপত্তি করব না।

লেখক : কথাশিল্পী ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক

No comments

Powered by Blogger.