কাজী ফখরুল ইসলাম বললেন-শিল্প বিকাশে ভূমিকা রাখছে বেসিক ব্যাংক

বাংলাদেশ স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (বেসিক ব্যাংক) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম বলেছেন, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে বেসিক ব্যাংক। একই সময়ে তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা বকেয়া ঋণ আদায় হয়েছে।
মূল লক্ষ্য ক্ষুদ্র শিল্প হলেও বড় শিল্প ও ব্যবসা খাতেও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ রয়েছে সরকারি মালিকানার বিশেষায়িত এ ব্যাংকের। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, কৃষি, নারী উদ্যোগ ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রেও গত দুই দশকে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছে বেসিক ব্যাংক। দুই দশকেরও বেশি সময়ের ধারাবাহিক সাফল্য এবং চলমান কার্যক্রম নিয়ে গত রবিবার রাজধানীর মতিঝিলে নিজ কার্যালয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ঝুঁকি এড়ানোর জন্য শতভাগ জামানত ছাড়া বেসিক ব্যাংক এখন ঋণ দেয় না। আর ঋণ অনুমোদনে অনিয়ম বা ব্যক্তিবিশেষের প্রভাব বিস্তারের কোনো সুযোগ নেই এ প্রতিষ্ঠানে।
কাজী ফখরুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকটির উদ্দেশ্য এর নামেই স্পষ্ট- বাংলাদেশ স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড। ক্ষুদ্র আকারের শিল্পোদ্যোগকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য একটি বিশেষায়িত ব্যাংক দরকার- এ তাগিদ থেকে ১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে যৌথ উদ্যোগে কার্যক্রম শুরু করে বেসিক ব্যাংক। সে সময় ব্যাংকটির ৭০ শতাংশ শেয়ার বিসিসি ফাউন্ডেশন এবং ৩০ শতাংশ শেয়ার বাংলাদেশ সরকারের হাতে ছিল। ১৯৯২ সালের জুনে সরকার ব্যাংকটির পুরো মালিকানা নিয়ে নেয়। দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কাজ করছে।
'ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে অবদান রাখার লক্ষ্য নিয়েই বেসিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিবছর এ খাতে পর্যাপ্ত অর্থায়ন করছে ব্যাংকটি। পাশাপাশি কৃষি খাতেও নিয়মিতভাবে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে।' এভাবেই বেসিক ব্যাংকের বিশেষত্ব তুলে ধরলেন কাজী ফখরুল ইসলাম।
সরকারের মালিকানায় থেকেও এটি স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়। এখন এটি ব্যবসাসফল ব্যাংক হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে- এ দাবি এর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের। ২০০৯ সালের অক্টোবরে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংকটির শাখা ছিল মাত্র ৩১টি। গত তিন বছরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬টিতে। আরো পাঁচটি শাখা খোলার প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমানে এর সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ আট হাজার ৬৯ কোটি টাকা। ঋণ ও অগ্রিম রয়েছে সাত হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। গত বছর ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ২১৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা এবং কর ও প্রভিশন-পরবর্তী মুনাফা ছিল ১৯৯ কোটি টাকা।
এমডি জানান, ২০১২ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংকটির সমুদয় সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ২৯৪ কোটি টাকা। ব্যাসেল-২-এর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকটির গচ্ছিত মূলধন ৭০০ কোটি টাকারও বেশি। গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৫৪১ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকটির মাধ্যমে আমদানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৯৬৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এবং রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ দুই হাজার ৪৭০ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
ফখরুল ইসলাম বলেন, বেসিক ব্যাংক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, বড় শিল্প, কৃষি এবং নারী উদ্যোগসহ বিভিন্ন উৎপাদনশীল খাতে ঋণ বিতরণ করে থাকে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে অবদান সম্পর্কে তিনি বলেন, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে এসএমই খাতে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে বেসিক ব্যাংক। একই সময়ে বকেয়া ঋণ আদায় হয়েছে তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কৃষি খাতে ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে ২৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ২০ শতাংশ। বাকি সময়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আশা করছেন তিনি। গত বছর লক্ষ্যমাত্রার ১১০ শতাংশ বেশি কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছিল। ওই বছর বিতরণ করা কৃষিঋণের পরিমাণ ১০৯ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ আদায়ে সাফল্যের সাক্ষ্য রয়েছে ব্যাংকটির হিসাবের খাতায়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আদায় করা খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যাংক কম্পানি আইনে জামানতবিহীন ঋণ দেওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও ঋণের ঝুঁকি কমাতে বর্তমান পর্ষদ শতভাগ সহায়ক জামানত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে। সুতরাং বেসিক ব্যাংকের কোনো ঋণই জামানতবিহীন থাকার সুযোগ নেই। জামানত নেওয়ার আগে ব্যাংক নিয়োজিত সার্ভেয়ারের মাধ্যমে সরেজমিনে জরিপ করা হয়। সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কিত যাবতীয় দলিল ব্যাংক নিয়োজিত আইনজীবীর মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হয়।
বেসিক ব্যাংকের ঋণ অনুমোদনে কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতির সুযোগ নেই উল্লেখ করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ঋণ অনুমোদনের প্রতিটি ধাপে ব্যাংকের নিজস্ব ঋণ নীতিমালা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলে বেসিক ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের প্রভাব বিস্তার বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কোনো সুযোগ নেই।
ঋণ বিতরণপ্রক্রিয়া সম্পর্কে কাজী ফখরুল ইসলাম বলেন, পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ঋণ অনুমোদনপত্রে সংযুক্ত সুনির্দিষ্ট শর্তাবলি পালন সাপেক্ষে বিতরণের পর্যায়ে আসে। সংশ্লিষ্ট শাখা ঋণ মঞ্জুরিপত্রের শর্তাবলি যথাযথভাবে পালনের পর ঋণের ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ঋণ বিতরণ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে শাখা ব্যবস্থাপকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে দায়ী থাকেন এবং এ ব্যাপারে কঠোর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করে কাজী ফখরুল বলেন, ঋণ অনুমোদনের আগে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। প্রথম ধাপে ঋণ আবেদন যাচাই-বাছাই করেন ব্যাংকের শাখা পর্যায়ের ব্যবস্থাপক ও শাখার ঋণ অনুমোদন কমিটির কর্মকর্তারা। এ কমিটি আবেদন অনুকূল বিবেচনা করলে তা পাঠানো হয় প্রধান কার্যালয়ে। দ্বিতীয় ধাপে প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যাচাই-বাছাই শেষে তাদের পর্যবেক্ষণ ও মতামতসহ প্রধান কার্যালয়ের ঋণ অনুমোদন কমিটির বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করে। এ পর্যায়ে ঋণ অনুমোদন কমিটির ১২ থেকে ১৩ জন সদস্যের সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে অনুকূল বা প্রতিকূল সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। এরপর তা প্রধান নির্বাহী এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পর্ষদের বিবেচনার জন্য উপস্থাপিত হয়। পর্ষদের সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে ঋণ আবেদন অনুমোদন বা নাকচ করা হয়ে থাকে।
দেশের বড় বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বেসিক ব্যাংকের গ্রাহক। এসবের মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ, ক্রিস্টাল গ্রুপ, প্রাসাদ নির্মাণ গ্রুপ, অ্যাপোলো কনস্ট্রাকশন, রূপায়ণ গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এএইচ জুট, সানজি গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপ, ফেবিয়ান গ্রুপ প্রভৃতি। এসব প্রতিষ্ঠান বেসিক ব্যাংকের সব নিয়ম মেনে সঠিক উপায়ে ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধও করছে। পর্যাপ্ত জামানত গ্রহণ সাপেক্ষে এসব ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে বলে জানান কাজী ফখরুল ইসলাম।
শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন ও লাভজনক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেসিক ব্যাংক যে আজ দেশের ব্যাংক খাতে দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে, এর পেছনে ছিল পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর গতিশীল নেতৃত্ব। ব্যাংকটির প্রশাসনিক দক্ষতা ও ব্যবসায়িক সাফল্য সম্পর্কে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মূল্যায়ন এমনই।
ব্যাংক কার্যক্রমের পাশাপাশি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে বেসিক ব্যাংক। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে গত ১০ মাসে ব্যাংকটি প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। নারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে ব্যাংকটি বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে উল্লেখ করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে আমরা কোনো ধরনের জামানত ছাড়াও ঋণ দিই। এসএমই খাতে ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে এসএমই মেলায়ও অংশ নেয় বেসিক ব্যাংক।'

No comments

Powered by Blogger.