আমরা গাজার জনগণ নীরবে মৃত্যু মেনে নেব না by মুসা আবু মারজাক

গাজা উপত্যকায় সাম্প্রতিক হামলার ব্যাপারে আবারও ইউরোপীয় দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্র আগের মতো একইভাবে আক্রমণকারীদের সমর্থন দেওয়ার অবস্থান গ্রহণ করেছে। ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিনিধি ক্যাথি আস্টন থেকে শুরু করে বারাক ওবামা_সবাই অভিযোগ করেছেন,
বর্তমান সংকটের জন্য প্রধানত হামাসের রকেট হামলাই দায়ী এবং ইসরায়েলের অধিকার আছে তার জনগণের জানমাল রক্ষা করার। তাঁরা যদি প্রকৃত ঘটনা খতিয়ে দেখতেন, তাহলে জানতে-বুঝতে পারতেন যে ইসরায়েলই এ হামলা শুরু করেছে। এবার সহিংসতার শুরু হয় ৮ নভেম্বর হঠাৎ ইসরায়েলের সেনারা হামলা চালিয়ে একটি ফিলিস্তিনি শিশুকে হত্যা করার পর। এর পরপরই ইসরায়েল আরো কয়েকটি হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনি উপদলগুলোকে উসকাতে থাকে পাল্টাহামলা চালানোর জন্য।
তার পরও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে চেষ্টা করা হয়েছে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য আলোচনা করার এবং মতৈক্যে পেঁৗছার। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে ইসরায়েলের অন্য এজেন্ডা রয়েছে। আল কসম ব্রিগেডের নেতা আহমেদ অল জাবারিকে টার্গেট করে হত্যা করে ফিলিস্তিনের উপদলগুলো এবং ইসরায়েলিদের মধ্যে সমঝোতা বিনষ্ট করা হয়েছে। শনিবার সে কথা নিশ্চিত করেছেন মিসরের প্রেসিডেন্ট।
নির্বাচন সামনে রেখে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের রক্তকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন, বিশেষ করে কট্টরপন্থী আভিগদর লিবারম্যানের সঙ্গে জোট করে আশানুরূপ জনপ্রিয়তা অর্জনে ব্যর্থ হয়ে এ পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে ফায়দা লোটার জন্য ইসরায়েলের আক্রমণ করার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ১৯৯৬ সালে সিমন পেরেজ আক্রমণ চালিয়েছিলেন লেবাননে। লৈমার্ট-লিবনি-এহুদ বারাক জোট ২০০৮ সালে হামলা চালিয়েছিল গাজায়। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অনৈতিক ও সংকীর্ণ অবস্থান গ্রহণ করা। তারা বারবার ভুল ব্যাখ্যা করেছে এবং সম্পূর্ণ পক্ষপাত করে আক্রমণকারীদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমের এই সমর্থন ইসরায়েলকে রাজনৈতিক কাভারেজ দিয়েছে এবং সে কারণে ইসরায়েলের নেতারা তাঁদের হামলা অব্যাহত রাখতে পেরেছেন। আর সে কারণেই আমাদের জনগণের কাছে এবং গোটা অঞ্চলে পশ্চিমা দেশগুলো দুষ্কর্মে সহযোগী বলে বিবেচিত হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো আবার তাদের জনগণের ফিলিস্তিনিদের অধিকারের ওপর যে সমর্থন রয়েছে, তাকে উপেক্ষা করে নিজেদের দুমুখো ও ভণ্ডামিপূর্ণ বলে প্রমাণ করেছে।
সারা বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষার নামে যে মানবাধিকারের কথা ইউরোপ বলে থাকে, সেটা থেকে অব্যাহতভাবে ফিলিস্তিনিদের বঞ্চিত করা হয়েছে। গাজার ১৭ লাখ মানুষকে ইসরায়েল অবরোধ করে রেখেছে। ৫ বছর ধরে খাদ্য, পানি, ওষুধ, এমনকি বেঁচে থাকতে প্রতিদিন যত ক্যালরি খাবার প্রয়োজন, সে ব্যাপারেও ইসরায়েল গুরুত্ব না দিয়ে বঞ্চিত করে রেখেছে। অথচ ইউরোপের সরকারগুলো এ ব্যাপারে কিছুই করেনি।
দখলদারি থেকে মুক্ত হওয়া এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ সব মানুষের অধিকার। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা যখনই এ অধিকার আদায় করতে চায়, তখনই তারা হয়ে যায় সন্ত্রাসী এবং নির্যাতনের সম্মুখীন হয়।
গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত হামলা সর্বশেষ গাজা যুদ্ধের পরও কখনো বন্ধ হয়নি। ২০০৯ সালের পর থেকে ২৭১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এর বিপরীতে ইসরায়েলি নিহত হয়েছে তিনজন। শেষ কয়েক দিনে সাত শর বেশি মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। রবিবার একই পরিবারের ১২ জন সদস্য নিহত হয়েছে ইসরায়েলের হামলায়।
ইসরায়েলের এই আগ্রাসন যে শুধু গাজায় চলছে তা নয়, অব্যাহতভাবে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করছে। পিএলও নেতার শান্তি প্রচেষ্টার পরও জেরুজালেম ও পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন করা হচ্ছে। ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির পর তৈখে ইসরায়েল দশ গুণ বসতি স্থাপন করেছে। তারা ইয়াসির আরাফাতকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ইসরায়েল কোনো কিছুই ফিরিয়ে দেয়নি।
এখন আভিগদর লিবারম্যান প্যালেস্টাইন অথরিটির প্রেসিডেন্ট আবু মাজেনকে উৎখাত করার চেষ্টা করছে।
হামাস দেশের জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য অন্যতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত (এবং পশ্চিমের তহবিলপ্রাপ্ত) একটি সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্ব যখন ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তাবিধানকে অস্বীকার করেছে, তখন আমরাই আমাদের রক্ষা করব। আমাদের জনগণের অধিকার রয়েছে আত্মরক্ষার। আমরা নীরবে আর মৃত্যু মেনে নেব না।
হামাস হয়তো ইসরায়েলকে পরাজিত করতে পারবে না, কিন্তু আমরা দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারি। আমরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকার জীবন অচল করে দেব। এটি যেকোনো স্বাধীন দেশের নাগরিকের অধিকার। গাজা ও হামাস নিঃসঙ্গ নয়। ইসরায়েলের শত্রুর সংখ্যাও বাড়ছে। আরব বিশ্বেও পরিবর্তন আসছে। ফিলিস্তিনের জনগণ এখন হামাসের প্রতি ভরসা ও নেতৃত্বে আস্থা রাখছে।
ইসরায়েল এমন এক কর্মে হাত দিয়েছে যে সঠিকভাবে হিসাব করতে পারেনি। তাদের অবশ্যই এর ফলাফল ভোগ করতে হবে। একটি অস্ত্রবিরতি হবে হামাসের ইচ্ছানুযায়ী, ইসরায়েলের ইচ্ছায় নয়। এর প্রথম শর্তটি হবে গাজা উপত্যকা থেকে নির্যাতনমূলক অবরোধ তুলে নেওয়া।
লেখক : হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর উপপ্রধান।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত নিবন্ধ ভাষান্তর করেছেন মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.