সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-ফিরে আসুক বিশ্বাস ... by সালমা আলী

কলেজে যখন পড়তাম, কক্সবাজার থেকে রামুর এই সীমা বৌদ্ধ বিহার ও পল্লী হয়ে প্রতিনিয়ত চট্টগ্রাম যেতে-আসতে হতো। সবসময়ই মনে হতো এ নিরিবিলি পরম শান্তির সি্নগ্ধ জায়গাগুলোয় একটু থেমে যাই; প্রায়ই নেমেও যেতাম। অনিন্দ্যসুন্দর এ জনপদের শান্তিময়তার পাশাপাশি সবচেয়ে অভিভূত হতাম পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্প্রীতি দেখে।
গত ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার কল্যাণে যখন শুনলাম সেই রামু এবং পটিয়ার পরম সি্নগ্ধ পল্লীতে সাম্প্রদায়িক শক্তির জঘন্য হামলা, মন্দিরে অগি্নসংযোগ, ভাংচুর, লুঠতরাজ তখন আমাকে শুধু সেই সময়ের স্মৃতিই বারবার কাতর করে দিচ্ছিল, যে স্থানটি আমার অন্যতম এক মায়াময় সময়ের সঙ্গে জড়িত তাই এখন আগুনে দগ্ধ, লণ্ডভণ্ড এক শঙ্কিত জনপদ।
ঘটনার পর যখন ছুটে যাই রামুতে, সাম্প্রদায়িকতার আগুনে পোড়া সেই মায়াময় স্থানের বীভৎস আর কদর্য রূপ দেখে আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। দেখলাম, হিংসার আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করেছে অহিংসার ধর্মমত প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধের প্রতীকী শরীর। কী এক বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা যেন লেপ্টে রয়েছে আক্রান্ত নারী ও শিশু-কিশোরীদের নির্নিমেষ চাহনিতে। সেদিন সব শিশুর মায়াময় চোখেও আমি দেখেছি অবিশ্বাসের দোদুল্যমানতা। তাদের স্বাভাবিক চঞ্চলতা অনুপস্থিত। যারা হয়তোবা সেদিন পর্যন্তও জানত না ধর্ম কী, কী তার তাৎপর্য। কিন্তু সেদিন তাদের চোখের সামনে উপাসনালয় পুড়তে দেখে সে অবোধ্য শিশুগুলো এখন অন্তত জানে, ধর্মের ভুল দোহাই দিয়ে হৃদয় জ্বালানোও সম্ভব যার ক্ষত থেকে যাবে আজীবন। কথা বলি নির্বাক বৌদ্ধপল্লীর শোকগ্রস্ত অধিবাসীদের সঙ্গে। আপন ভেবে দুঃখ ভাগ করে নিতে শুরুতে নারীরা সাবলীল আন্তরিক থাকলেও পরিচয়ক্রমে যখন জানতে পারল আমার ধর্মপরিচয় মুহূর্তের মধ্যে তাদের চোখে আমি এক পরিবর্তিত বিহ্বল দৃষ্টি দেখতে পেলাম, যেখানে আর নির্ভরতার কোনো লেশমাত্র ছিল না বরং ছিল হঠাৎ আতঙ্কিত এবং বিশ্বাসভঙ্গের এক অব্যক্ত বেদনাগ্রস্ত অভিযোগপূর্ণ দৃষ্টি। হঠাৎই অনেক দূরের হয়ে গেলাম তাদের কাছে। ঘটনার পরপর বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সত্যানুসন্ধানের প্রতিবেদন এবং সরেজমিন গিয়ে তাদের বর্ণনায় জানতে পারলাম সেদিনের সে লোমহর্ষক ঘটনার আদ্যোপান্ত। দু'দিনে সেখানের ১৯টি বৌদ্ধ বিহারসহ প্রায় ৪৫টি বাড়িতে অগি্নসংযোগ করা হয়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৭০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ৩০৬ বছরের পুরনো সীমা বৌদ্ধবিহার ও চার শতাধিক বুদ্ধমূর্তিসহ অনেক দুর্লভ ঐতিহাসিক নথি। এখানে আর বিশদ করে বিস্তারিত বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন, যা ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকার কল্যাণে বিস্তারিত সবারই জানা। জাপান, জার্মানিসহ আরও কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিদের দেখলাম সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি চিন্তাভাবনা করছেন আবার বিহার ও প্যাগোডাগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার। প্রধানমন্ত্রীও ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ধ্বংস করে ফেলা বিহারগুলো অচিরেই আবার গড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু যে অমূল্য প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনগুলো আমরা হারিয়েছি তা কখনোই ফেরত পাব না। এ সম্বন্ধে এক ভিক্ষু বেদনাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, 'যা হারিয়েছি, তা এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে আবার একজন ভগবান গৌতম বুদ্ধের জন্ম হতে হবে, তবেই তা আবার ফিরে পাওয়া যাবে।' মুসলমান পরিবারগুলোর মধ্যেও দেখা গেল ঘটনার আকস্মিকতায় বিব্রত হওয়া অভিব্যক্তি, বলছিলেন, হঠাৎ করেই বিশ্বাসের জায়গাটা হারিয়ে গেল, হারিয়ে গেল এতকালের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অত্যন্ত গর্বের জায়গাটি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এ যাবৎকালে সংঘটিত সবচেয়ে বড় এ সাম্প্র্রদায়িক হামলায় যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল বিপন্নের প্রতি হাত বাড়িয়ে দেওয়ার, তাদের সাহস জোগানোর তখন দেখা গেল সরকার এবং বিরোধীদলীয় পক্ষ ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালেই একে অন্যের সমালোচনায় মুখর এবং পারস্পরিক দোষারোপে মগ্ন। মনে পড়ল নব্বইয়ের দশকে ভারতের অযোধ্যায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সময় দেখেছি তৎকালীন বিজেপি সরকারের সঙ্গে জনস্বার্থে দলমতের ঊধর্ে্ব উঠে কাজ করেছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা সোনিয়া গান্ধী বস্তুত যে রূপটিই প্রকৃত ও শক্তিশালী গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি। যা বস্তুত এ মুহূর্তে এ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন সর্বাগ্রে।
এ সম্প্রীতির বাংলাদেশের সব ধর্মের অনাদিকাল থেকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। এখানে কোনো ধর্মের লোকই কখনোই মনে করে না এ দেশ এককভাবে তার ধর্মের জনগণেরই। এখানে যে মাঠে প্রতি বছর পবিত্র ঈদের নামাজ আদায় করা হয়, সে মাঠেই প্রতিবছর মহাআড়ম্বরে দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়। যে মাদ্রাসার মাঠ সারাবছর মুসলিম ছাত্রদের কলকাকলিতে মুখর থাকে, ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়, সে মাদ্রাসা মাঠেই অন্য ধর্মাবলম্বীদের দেবদেবী ভক্তদের অর্ঘ্যে পূজিত হয়। ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর থেকে অনেকেই গিয়েছেন, ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের সমবেদনা জানিয়েছেন। সে অসাম্প্র্রদায়িক চেতনাই আজ বারবার বলছে, শুধু মৌখিক সহানুভূতিই নয়, প্রয়োজন এহেন তীব্র নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডের সঠিক কারণটি জানা কার বা কাদের ইন্ধন ছিল ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করা, কোন সে ধর্মহীন গোষ্ঠী আজ বহির্বিশ্বে সম্প্রীতির বাংলাদেশকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে। খুঁজে দেখতে হবে পরস্পর দোষারোপের রাজনীতির ডামাডোলের আড়ালে, প্রশাসনের নির্লিপ্ত ভূমিকার পেছনে অন্য কোনো গভীর অন্তর্কোন্দল কাজ করছে কি-না, যা বস্তুত হিসাবের মধ্যেই ধরা হচ্ছে না। সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে, পার্বত্য অঞ্চলে অশান্তি সৃষ্টি এবং তৎসংলগ্ন সীমান্তবর্তী উভয় এলাকাগুলোতে শুধু ধর্মকে পুঁজি করে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কোনো সুযোগলোভী চক্র অন্য কোনো সংবেদনশীল ইস্যুকে উস্কে দিচ্ছে কি-না। কথা বলছিলাম, রামুর মেরংলোয়া সীমা বিহারের অধিবাসীদের সঙ্গে, যেখানে একজন কলেজ শিক্ষক জোর গলায় বলেন, 'ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রকৃত দোষীদের শাস্তি চাই।' একজন ভিক্ষু (সঙ্গত কারণেই নাম উহ্য রাখা হলো) বলেন, 'সিসিটিভিতে হামলাকারীদের ছবি আছে, আপনাদের সবার সহযোগিতা পেলে প্রকৃত হামলাকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এ হামলার মূলোৎপাটন করতে না পারলে ভবিষ্যতে অনুরূপ হামলা বারবার হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। ফলে দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি বিনষ্ট হবে।'
মনে পড়ছিল রাসূলুল্লাহর (সা.) সতর্কবাণী। যে উক্তি অনেকেই ইতিমধ্যে তাদের লেখনীতে উদ্ধৃত করেছেন, 'তোমাদের কেউ যদি কোনো অমুসলিমের প্রতি অন্যায় করে, তবে আমি কিয়ামতের দিন সেই মুসলমানের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবো।' দোষীদের স্বচ্ছ বিচার ব্যবস্থা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই পারে সে জনপদসহ সবার মাঝে আবার পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গাটি ফিরিয়ে আনতে।
শান্তিপূর্ণ দেবালয় আজ আগুনে পুড়ে ছাই। বিপুল ধ্বংসরাজির মধ্যে মানবজাতির প্রতি পরম ধৈর্যের দৃষ্টি মেলে সৌম্য-শান্ত বুদ্ধমূর্তি তখনো স্ব-মহিমায় অধিষ্ঠিত। আমার মনে হচ্ছিল, এহেন ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড দেখে তখনও যেন সে বুদ্ধমূর্তির দৃষ্টি একটি কথাই বলছে, 'জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক, মঙ্গল লাভ করুক।'

সালমা আলী :মানবাধিকার কর্মী
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি

No comments

Powered by Blogger.