সংসদে আলোচনা- টিআইবির কর্মকাণ্ড বন্ধের দাবি

৯৭ শতাংশ সাংসদ অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত বলায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সাংসদেরা। এ ছাড়া সাংসদেরা দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থার নির্বাহী পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সংসদের বিশেষ অধিকার কমিটিতে তলব এবং সংস্থাটির কার্যক্রম নিষিদ্ধেরও দাবি জানান।
জাতীয় সংসদের অনির্ধারিত আলোচনায় গতকাল সোমবার এ দাবি জানানো হয়। এ সময় স্পিকার আবদুল হামিদ বলেন, ‘সরকারি দল ভালো না, বিরোধী দলও ভালো না। তবে দেশটা পরিচালনা করবে কে? ইজ ইট টিআইবি? তাহলে টিআইবি সামনের নির্বাচনে সুশীল সমাজ নামে আসুক। জনগণ যদি তাদের ক্ষমতায় বসায়, তখন সব ইতিবাচক হবে!’
এর আগে সরকারি দলের তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এভাবে কাজ করার অধিকার টিআইবির নেই। আপনি (স্পিকার), আমি রাজনীতি করি। আমরা পোড় খাওয়া মানুষ। রাজনীতি করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। অথচ নির্বাচনের এক বছর আগে তাঁরা এই প্রতিবেদন দিলেন। আমি বলতে পারি, এখানে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন। টিআইবি কি কোর্ট বসিয়েছে? জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের প্রতিবেদন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
টিআইবিকে সংসদে তলবের দাবি জানিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, টিআইবিকে ডাকেন। ডেকে বলেন, তাদের কাছে কী তথ্য আছে। বিশেষ অধিকার কমিটির বৈঠক ডাকেন। যাঁরা এই প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকে তথ্য চান। কী তথ্য তাঁদের কাছে আছে। এ সময় উপস্থিত সাংসদেরা টেবিল চাপড়ে তোফায়েল আহমেদের দাবির প্রতি সমর্থন জানান।
টিআইবির প্রতিবেদনকে দুঃখজনক উল্লেখ করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, বলা হয়েছে, ৯৭ শতাংশ সাংসদ অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত। ১৬ কোটি লোকের মধ্যে মাত্র ৬০০ জনের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে টিআইবি যে কাজটি করেছে, তা অনৈতিক। এভাবে কাজ করার অধিকার টিআইবির নেই।
অনির্ধারিত এই আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। টিআইবির কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, টিআইবির প্রতিবেদন কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সংস্থাটি জরিপের স্বীকৃত পদ্ধতিও অনুসরণ করেনি। ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে ৬০০ জন পছন্দমতো লোকের মতামত নিয়ে এ প্রতিবেদন দিয়েছে। সাংসদদের ঢালাওভাবে চরিত্র হনন করে সংসদকে অকার্যকর করতে একটি মহল গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারাই টিআইবিকে দিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করিয়েছে। টিআইবি এখন নিজেদের সুপার পাওয়ার মনে করছে।
শেখ সেলিম বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা কি এনজিওর কাছ থেকে সার্টিফিকেট নেবে, নাকি জনগণের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নেবে? টিআইবি সংসদকে অকার্যকর প্রমাণ করতে চায়। ওয়ান-ইলেভেনের পর তারা বিভিন্ন জেলায় গিয়ে তাদের পছন্দমতো লোক খুঁজেছিল। নির্বাচনে এদের অনেকের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।’
শেখ সেলিম আরও বলেন, তারা মাইনাস টু ফর্মুলায় ব্যর্থ হয়ে তৃতীয় শক্তি উত্থানের চেষ্টা চালাচ্ছে। এখন সাংসদদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড রোধে আইন করার পরামর্শ দিচ্ছে। জনগণের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। সাধারণ সভা-সমাবেশ আর টেলিভিশন টক শোতেই এদের দেখা যায়।
টিআইবির আয়ের উৎস বের করার জন্য দুদক ও অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়ে শেখ সেলিম বলেন, টিআইবিকে বিশেষ অধিকার কমিটিতে ডেকে তাদের প্রতিবেদনের সমর্থনে প্রমাণ দিতে বলেন। প্রমাণ তারা দিতে পারবে না। তাদের সীমাহীন বাড়াবাড়ি বরদাশত করা যাবে না। তারা যদি নীতির মধ্যে না থাকে, দরকার হলে বাংলাদেশে তাদের কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের শাহ জিকরুল আহমেদ বলেন, ‘এনজিওর কর্মীরা, যাঁরা এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তাঁদের আয়কর নথি জনগণের সামনে প্রকাশ করা হোক। আমি আমার আয়কর নথি দেব। যদি কোনো ভুল থাকে, তাহলে আমি পদত্যাগ করব।’
তারানা হালিম বলেন, ‘আমার প্রশ্ন, এরা কারা। তারা কি সুবিধাবঞ্চিত? দেশের ১৫ কোটি লোকের মধ্যে ৬০০ লোকের মতামত গ্রহণ করেছে। টিআইবি নিজেরাই নিজেদের প্রতিবেদনের দায় গ্রহণ করেনি। বলেছে, এটা খণ্ডিত প্রতিবেদন।’
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক বলেন, ‘সংসদ সদস্য হয়েছি, কিছু লোকের কাছে এটাই যেন অপরাধ। টিআইবি আমাকে দাওয়াত করেছিল, আমি বলেছিলাম, এই হলের ভাড়া আর খাওয়ার খরচ কোথা থেকে আসল তার হিসাব আমার বাসায় পাঠাবেন। এখনো পাঠায়নি। আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি, ইফতেখারুজ্জামান তা পাঠাতে পারবেন না।’
সুবিদ আলী ভুঁইয়া বলেন, ‘এই রিপোর্ট কিসের ভিত্তিতে দিল? আমাদের দেশের কিছু মহল আছে যা ইচ্ছা তা-ই বলে। বাক্স্বাধীনতার নামে তারা আমাদের চরিত্র হনন করে।’
নুরুল ইসলাম বলেন, টিআইবির প্রতিবেদনের মাধ্যমে দেশের জনগণকে অপমান করা হয়েছে।
সবশেষে স্পিকার আবদুল হামিদ জানান, সবার বক্তব্য শুনে এবং জ্যেষ্ঠ সাংসদদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, টিআইবি ৯৭ শতাংশ সাংসদকে নিয়ে প্রতিবেদন দিল। কিন্তু ৯৭ শতাংশ জায়গাতেই তো তারা গেল না।
সাংসদদের উদ্দেশে স্পিকার বলেন, ‘টিআইবির মনোনীত ৬০০ লোক কারা? এরা কি তাদের বেতনভুক্ত লোক, না কোনো দলের? কিছু মিডিয়া আছে, যারা সংসদ সদস্যদের চরিত্র হননে উঠেপড়ে লেগেছে।’
সাংসদদের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে টিআইবির উদ্দেশে স্পিকার বলেন, ‘আমরা মানুষ, ফেরেশতা নই। ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। সঠিক চিত্র তুলে ধরলে তো আমরা সংশোধিত হতে পারি।’
সংসদে টিআইবি নিয়ে আলোচনার বিষয়ে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁরা দুর্নীতি দমনের অঙ্গীকার করে জনগণের দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছেন। অথচ যাঁরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারকে সজাগ করতে চান, তাঁদের বের করে দেওয়ার কাজেই সেই ক্ষমতা তাঁরা এখন ব্যবহার করতে চান। এতে প্রমাণিত হয়, ক্ষমতার কত বড় অপব্যবহার তাঁরা করছেন এবং গণতন্ত্রের প্রতি তাঁদের নিষ্ঠা কতখানি। এসব করে তাঁরা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন এবং এ কারণে সারা বিশ্বে জাতি হিসেবে আমাদের দুর্নীতির কলঙ্ক বহন করতে হয়।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদেরা টিআইবির কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বলেছেন। এ বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
স্কুলে ভর্তির জন্য সাংসদদের ২ শতাংশ কোটা নিয়ে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন সম্পর্কে স্পিকার বলেন, ‘আমার জিন্দেগিতে এ ধরনের কোটা পেলাম না। সাংসদদের জন্য এ ধরনের কোটার কথা শুনিনি। এটা করে তো ধূম্রজালের সৃষ্টি করা হচ্ছে।’ তিনি এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে সঠিক তথ্য দাবি করেন।
সবশেষে সংসদের অধিবেশন আজ বিকেল চারটা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.