ফল বিশ্লেষণ-কেবলই পরাজয়ের স্বাদ পাচ্ছে আওয়ামী লীগ by পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য

দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মতামত উপেক্ষা, নির্বাচনে ভুল প্রার্থী মনোনয়ন, বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে না পারা এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে একের পর এক পরাজয়ের স্বাদ নিতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে। সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাটার টানও এর একটি কারণ বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
জাতীয় সংসদের শূন্য আসনে উপনির্বাচন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই এসব ব্যর্থতার খেসারত দিতে হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের।
এখনই সতর্ক না হলে আগামী সাধারণ নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন দলের প্রভাবশালী অনেক নেতাও।
বর্তমান সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নেয়নি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এর পরও পরাজয় এড়াতে পারছে না ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়লাভ করা আওয়ামী লীগ। দলীয় নেতারাই বলছেন, সরকারের নানা ব্যর্থতা আর মাঠ নেতাদের সঙ্গে মন্ত্রী-এমপিদের দূরত্ব কমাতে না পারলে আওয়ামী লীগকে বড় ধরনের খেসারত দিতে হবে।
এদিকে সমস্যা সমাধানের দিকে মনোযোগ না দিয়ে পরজিত হওয়ার পর 'নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে'- এমন কিছু কথাই বলা হচ্ছে দলটির পক্ষ থেকে। আবার স্থানীয় নির্বাচনে পরাজয়ের পর 'এটা স্থানীয় নির্বাচন, জাতীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়বে না'- এমন মন্তব্য করে পরাজয়ের গ্লানি ঢাকার চেষ্টা করছে শাসক দলটি।
গত রবিবার অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইল-৩ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী দ্বিগুণেরও বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলাকায় জনপ্রিয় আমানুর রহমান খান রানাকে বঞ্চিত করে শহিদুল ইসলাম লেবুর মতো কম জনপ্রিয় এবং কম প্রভাবশালী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের দুই দিন আগে রানাকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়।
সূত্র জানায়, টাঙ্গাইলের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর আপত্তির কারণে মনোনয়নবঞ্চিত হন রানা। এলাকার অন্য এক মন্ত্রীও পুরনো দ্বন্দ্ব পুষে রেখে রানার বিরোধিতা করেন। পরে ওই দুই মন্ত্রীর প্ররোচনায় বহিষ্কারও করা হয় রানাকে।
বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচনে ভুল হচ্ছে কি না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নানা দিক বিবেচনা করে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়। যেমন- দলের সঙ্গে প্রার্থীর সম্পর্ক, জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি। এর পরও প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে কিছু ভুল থাকতেও পারে।'
দল কেন বিদ্রোহী প্রার্থীদের বসে আনতে পারছে না- জানতে চাইলে হানিফ বলেন, এই নির্বাচনগুলোতে বিএনপি অংশ নিচ্ছে না। শুধু আওয়ামী লীগ অংশ নেওয়ার কারণে বিদ্রোহীদের ব্যাপারটা গুরুত্ব পায়নি। তা ছাড়া এই নির্বাচনগুলোকে টেস্ট কেস হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি।
পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে কি না- জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেতা হানিফ বলেন, ওই সময় প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে দল কঠোর অবস্থান নেবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী পরাজিত হয়েছে, এটা হতেই পারে।' প্রার্থী নির্বাচনে ভুল ছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন- দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড, জেলা ও উপজেলা নেতাদের সঙ্গে কথা বলেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মতিয়া চৌধুরী দাবি করেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে- এটাই সরকারের সফলতা।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) আসনের উপনির্বাচন ক্ষমতাসীন দল জয় পেলেও সেখানেও ছিলেন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী। বারবার চেষ্টা করেও বিদ্রোহী প্রার্থীকে নির্বাচনের মাঠ থেকে সরাতে পারেননি দলের শীর্ষ নেতারা। তবে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর পরিবারের প্রতি এলাকাবাসীর সহানুভূতি থাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী তাজউদ্দীনের কন্যা সিমিন হোসেন রিমির পক্ষে গেছে জন রায়। সিমিন হোসেন রিমির বিপক্ষে নির্বাচনের মাঠে ছিলেন তাঁরই চাচা এবং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিমন্ত্রী আফসার উদ্দিন আহমেদ।
এর আগে ১৯ জানুয়ারি ছিল নরসিংদী পৌরসভা নির্বাচন। সেখানেও আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ছিল আওয়ামী লীগ। নরসিংদী পৌরসভার জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেন সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর ওই নির্বাচনে তাঁর ভাই কামরুজ্জামান কামরুলকে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সমর্থন দিলেও তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচন করেন নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোন্তাজ উদ্দিন ভুঁইয়া। জেলা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতার সমর্থন পাননি কামরুল। পাশাপাশি নরসিংদীর এক প্রভাবশালী মন্ত্রীও ছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু কামরুলের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর গত তিন বছরে পৌরসভা নির্বাচন হয়েছে মোট ২৩৭টি। এগুলোর মধ্যে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জিতেছেন ৯০ জন, আর বিএনপির প্রার্থী জিতেছেন ৯৫ জন। সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে তিনটি। এর সব কয়টিতেই মেয়র পদে হেরেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। সংসদের শূন্য আসনে উপনির্বাচন হয়েছে পাঁচটি। এতে আওয়ামী লীগ হেরেছে দুটিতে। অথচ আগে সবগুলোই ছিল আওয়ামী লীগের দখলে। এ ছাড়া চার হাজার ২৯৮টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দুই হাজার ১৯৭টিতেই হেরেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা। অথচ তিন বছর আগের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জিতেছিল ৩০০ আসনের ২৬২টিতেই। এর মাত্র ২৪ দিন পরই অনুষ্ঠিত ৪৭৫টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ ৩০৪টিতে জয়ী হয়। পৌরসভায় বিএনপির কাছে ধরাশায়ী হওয়াার পরপরই আওয়ামী লীগ ধাক্কা খায় হবিগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচনে। তবে একই দিনে অনুষ্ঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের উপনির্বাচনে জয় ধরে রাখে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পালা শুরু হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে। ২০১০ সালের ১৭ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী পরাজিত হন বিএনপি সমর্থিত এম মঞ্জুর আলমের কাছে। ৯৫ হাজার ৫২৮ ভোটের ব্যবধানে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারান এক সময়কার আওয়ামী লীগ নেতা ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্টজন মঞ্জু। ওই নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে দল সমর্থন দিলেও তাঁর বিপক্ষে অবস্থান নেন চট্টগ্রামে দলের প্রভাবশালী নেতারা।
এর পর ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরজয়ের স্বাদ পায় আওয়ামী লীগ। সেখানেও জনমত উপেক্ষা করে সেলিনা হায়াত আইভীর পরিবর্তে দল সমর্থন দেয় শামীম ওসমানকে। অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতাকে শামীম ওসমানের পক্ষে নামিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। দলের মনোনীত প্রার্থীকে এক লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন আইভী।
গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগকে খেসারত দিতে হয়েছে ভুল প্রার্থী নির্বাচনের জন্য। প্রায় দ্বিগুণ ভোটে পরাজিত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অধ্যক্ষ আফজল খান। ওই নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠু ও নূর উর রহমান মাহমুদ।

No comments

Powered by Blogger.