নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে : খালেদা জিয়া-আর একবার সুযোগ দিন দেশের চেহারা পাল্টে দেব by রফিকুল ইসলাম

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, সরকারকে হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করতে হবে, নয়তো ক্ষমতা থেকে চিরবিদায় নিতে হবে। কারণ তত্ত্বাবধায়কের দাবি এখন জনগণের। এই দাবি না মানলে আগামী দিনে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়ার কথা জানিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন,
'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে।' বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে (বেলস পার্ক) গতকাল সোমবার বিকেলে ১৮ দলীয় জোট আয়োজিত জনসভায় খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন।
জনগণের প্রতি আহবান জানিয়ে খালেদা জিয়া জনসভায় বলেন, 'আমাকে আর একবার ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ দিন, আমি বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দেব। যদি চেহারা পাল্টাতে না পারি, তবে আপনারা যা শাস্তি দেবেন তা মাথা পেতে নেব।'
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, 'আওয়ামী লীগ চিরদিন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখছে। সে জন্যই সংসদ বহাল রেখে জাতীয় নির্বাচনের পাঁয়তারা করছে তারা। কিন্তু এটা পূরণ হবে না। আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না।' তিনি বলেন, 'আওয়ামী লীগকে বলব, এখনো সময় আছে, সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করুন। নইলে এ দেশে আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন আর হতে দেওয়া হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়।'
সরকারের সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, 'এই সরকারের হাতে, এই প্রধানমন্ত্রীর হাতে শুধু জনগণের রক্ত, রক্ত আর রক্ত। যে প্রধানমন্ত্রীর হাতে জনগণের রক্ত, সেই প্রধানমন্ত্রীকে জনগণ আর ক্ষমতায় রাখতে পারে না।' তিনি বলেন, 'এ সরকারের মন্ত্রীরা সব অযোগ্য, অপদার্থ ও ব্যর্থ। তাদের দিয়ে দেশের উন্নয়ন হবে না। এরা লুটপাটে ব্যস্ত, ব্যস্ত কমিশন নেওয়া নিয়ে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগসহ যত লীগ আছে, তাদের লুটপাটের ফ্রি লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে সরকার। এসব লীগ যতই মানুষ খুন করুক না কেন, তাদের কেউ কিছু বলবে না। এরা নিজেরা নিজেরাই মারামারি করছে।'
খালেদা জিয়া বলেন, 'এই সরকার প্রশাসন দলীয়করণ করেছে। পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীতেও দলীয়করণ চলছে। তাই পুলিশ প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে না। ছাত্রলীগের সঙ্গে লুটপাট করতে পুলিশকে বাধ্য করা হচ্ছে। ছাত্রলীগ দানব হয়ে গেছে। অস্ত্র নিয়ে ঘুরলেও তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।'
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, বিগত চার বছরে বরিশালে কোনো উন্নয়ন হয়নি। অবহেলিত এ অঞ্চলে কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। তিনি জনগণের উদ্দেশে বলেন, 'এই সরকার মিথ্যাবাদী সরকার, তাদের বিশ্বাস করবেন না।' যুবসমাজের প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, 'এই সরকার ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; কিন্তু চাকরি দেয়নি। যুবসমাজকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, 'সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিয়ে আন্দোলন করতে হবে।'
আওয়ামী লীগকে বিশ্বচোর আখ্যা দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, 'পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হওয়ার আগেই তা চুরি হয়ে গেছে। পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের দুর্নীতির জন্য হতে পারেনি। আমরা ক্ষমতায় গেলে দুটি পদ্মা সেতু তৈরি করা হবে।' ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্য শরিকদের প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, 'আওয়ামী লীগের জোট ছেড়ে বিএনপির জোটে ঐক্যবদ্ধ হোন।'
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ারের সভাপতিত্বে জনসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আ স ম হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমান, সেলিমা রহমান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সাদেক হোসেন খোকা, হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান ও বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বক্তব্য দেন।
আরো বক্তব্য দেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি অলি আহমদ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মজিবুর রহমান, খেলাফত মজলিসের চেয়ারম্যান মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামী, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নিলু, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক লীগের সভাপতি খন্দকার গোলাম মূর্তজা, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আবদুল হক কাউসারী প্রমুখ।
বৌদ্ধপল্লীতে হামলার ঘটনায় সরাসরি আওয়ামী লীগ ও সরকারকে দায়ী করেছেন খালেদা জিয়া। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, 'যে সরকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেই সরকারের কাছে সাধারণ মানুষও নিরাপদ নয়। এরা কেবল লুটপাট করতে জানে। ওই ঘটনার দিনও এরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে মূল্যবান সম্পদ লুট করেছিল।'
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়ে খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তিনি পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, হলমার্ক ও ডেসটিনির অর্থ কেলেঙ্কারির কথা তুলে ধরে বলেন, 'চুরির কারণে সরকার বিশ্বচোর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তাই মানুষজন বলে, সারা দেশে একি সুর, আওয়ামী লীগ বিশ্বচোর।'
ক্ষমতায় গেলে যা করবেন : খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ক্ষমতায় গেলে দুটি পদ্মা সেতু করা হবে; দেশের এক কোটি দরিদ্র মানুষকে রেশনিংয়ের আওতায় আনা হবে; বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে; দেশের সব রকম দুর্নীতি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে; বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যমের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে; সংবিধানের অসংগতিপূর্ণ বিধান বাতিল করা হবে; প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা বাড়ানো হবে এবং খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্য কমিয়ে আনা হবে। তিনি আরো বলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা হবে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে নতুন শিল্প-কারখানা এবং বন্ধ থাকা শিল্প-কারখানা চালু করা হবে। পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা হবে। কৃষকদের সব ধরনের সহায়তা করা হবে। বিশেষ করে সার-বীজে বিশেষ ভর্তুকি দেওয়া হবে। নারী শিক্ষার অগ্রগতির জন্য ডিগ্রি পর্যন্ত তাদের শিক্ষা অবৈতনিক করা হবে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ করা হবে। বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর এবং বরগুনায় নদীভাঙন রোধে প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
বঙ্গবন্ধু উদ্যান জনসমুদ্র : সকাল থেকে বিভিন্ন স্থান থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করে। দুপুর ১২টার আগেই বঙ্গবন্ধু উদ্যান ভরে যায়। সমাবেশের জন্য নির্ধারিত এলাকা ছাপিয়ে আশপাশের সড়ক, অলিগলি ছিল জোটের হাজার হাজার নেতা-কর্মী আর সমর্থকের দখলে। বিকেল সোয়া ৩টায় সমাবেশস্থলে পৌঁছান বিরোধীদলীয় নেতা। বিকেল সোয়া ৪টায় শুরু করে খালেদা জিয়া প্রায় ৪০ মিনিট বক্তব্য দেন।
জামায়াত-শিবিরের বিব্রতকর উপস্থিতি : ১৮ দলের মহাসমাবেশের মঞ্চের সামনে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের উপস্থিতি ছিল বিএনপি-ছাত্রদলের প্রায় সমানতালে। সমাবেশে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক গোলাম আযমসহ জামায়াতের নেতাদের প্রতিকৃতি প্রদর্শনের বাহুল্য ছিল বিএনপি নেতা-কর্মীদের কাছেও বিব্রতকর।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রথম দফা জামায়াতের নেতা-কর্মীরা বিক্ষিপ্তভাবে সমাবেশস্থলে আসে। তখন তাদের হাতে কোনো ব্যানার-ফেস্টুন ছিল না। ঝালকাঠি-২ নির্বাচনী এলাকা থেকে কয়েক হাজার নেতা-কর্মী নিয়ে দ্বিতীয় মিছিলটি আসে মিঞা আহমেদ কিবরিয়ার নেতৃত্বে। এর কিছু সময় পরই হাতে ডিজিটাল ব্যানার, মাথায় কাগজের টুপি, দলের আটক ছয় নেতার পৃথক প্রতিকৃতি নিয়ে জামায়াতের বড়সড় একটি দল আসে। এ ছাড়া দলটির কর্মীরা সভাস্থলের প্রবেশপথে কয়েক দফা মিছিল করে।
জেলা বিএনপির সভাপতি আহসান হাবিব কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের চেয়ে জামায়াত নেতাদের প্রতিকৃতি ছিল বেশি। এটা ছিল বিএনপির জন্য বিব্রত হওয়ার মতো।' তবে মহাসমাবেশে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধের বিচার বা এ অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক কারো মুুক্তির বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেননি।

No comments

Powered by Blogger.