কালান্তরের কড়চা-রাজনৈতিক সুনামির আগাম সতর্কবার্তা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

এবার আমার ঢাকা অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়নি। অবশ্য আমি ঢাকায় এলে প্রতিবারই যে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, তা নয়। বেশির ভাগ সময় তিনি অনুগ্রহ করে ডেকে পাঠান, সব ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন, তা রাত ১০টা বা ১১টা যা-ই হোক।
কোনোবারই আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থী হইনি, তিনিই দয়া করে সাক্ষাৎ দান করেছেন। এ বছর যে তিনি লন্ডনে গিয়েছিলেন, তখনো তাঁর অতি ব্যস্ততার মধ্যেও আমি যাতে হোটেলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি সে ব্যবস্থা করেছিলেন ও বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর একটি কপি তিনি নিজে ও শেখ রেহানা সই করে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। সুতরাং এবার ২০ দিন ঢাকায় অবস্থানকালে তাঁর সাক্ষাৎ পাব না, এটা ভাবিনি।
সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় এসেই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে আমি টেলিফোন করি এবং তাঁকে পাই। এর পর আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। মোনায়েম সরকারের কাছে শুনেছি, প্রধানমন্ত্রী আমাকে বেলারুশ প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য তাঁর স্টাফকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারা নাকি তাঁর সে নির্দেশ শোনেনি। এটাও আমার কাছে একটা রহস্য। এখন লন্ডন যাত্রার মুহূর্তেও শুনছি (তা-ও মোনায়েম সরকারের মুখে) প্রধানমন্ত্রী আমাকে সাক্ষাৎ দান করতে চান। হয়তো তা আর সম্ভব হবে না। আমি এখন লন্ডনে ফিরে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে কেন, তাঁর আগেরবারের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলেও কখনো তাঁর সঙ্গে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেখা করতে চাইনি। কারণ তাঁর কাছে আমার কোনো তদবির-তদারকি ছিল না এবং এখনো নেই। ভবিষ্যতে আবার যদি তিনি প্রধানমন্ত্রী হন (প্রার্থনা করি) তাহলেও তাঁর কাছে কোনো ব্যক্তিগত তদবির থাকবে না। এবার যে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়েছিলাম, তা আমার এলাকার বৃহত্তর স্বার্থে একটি তদবিরের জন্য। কিন্তু দেখা হলো না।
কলকাতার বিখ্যাত সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন পণ্ডিত নেহরুর ব্যক্তিগত বন্ধু। সম্ভবত চলি্লশের দশকের একেবারে শেষ প্রান্তে অথবা পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় তিনি রাশিয়া সফরে আমন্ত্রিত হন। কিন্তু তাঁকে ভারত সরকার অনুমতি দেয়নি। তিনি বহু চেষ্টা করেও রাশিয়া ভ্রমণে আমলাতান্ত্রিক বাধা অতিক্রম করতে পারেননি। তখন তিনি সরাসরি নেহরুর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন। নেহরু তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বারবার চেষ্টা করেও নেহরুর সাক্ষাৎ পাননি। তাঁকে সাক্ষাতের জন্য যে তারিখটি দেওয়া হয়েছিল, সেটি তাঁর রাশিয়া যাত্রার নির্ধারিত দিনের অনেক পরে। সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার তাঁর এক আত্মকথায় এ সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, 'রাশিয়ার একটি লৌহযবনিকা আছে বলে প্রচার করা হয়; কিন্তু ভারতেও যে তার চেয়ে শক্ত একটি খাদি যবনিকা আছে তা জানতাম না।' বাংলাদেশে সত্যেন মজুমদারের এই উক্তিটি স্মরণ করে বলতে হয়, এখানেও প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে একটি স্তাবক যবনিকা তৈরি হয়েছে। এ বি এম মূসা, আবেদ খানের মতো প্রবীণ সম্পাদকদের কাছেও শুনেছি, তাঁরা বারবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার অ্যাপয়েনমেন্ট চেয়েও পাননি। অথচ শত ব্যস্ততার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিল তাঁর শত্রু-মিত্র সাংবাদিকদের জন্য অবারিত দ্বার। এ বি এম মূসা যখন আমার কাছে বারবার অভিযোগ করেন, তিনি কয়েকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে অ্যাপয়েনমেন্ট চেয়েও পাননি, অথচ বঙ্গবন্ধুর কাছে পেতেন, তখন তাঁকে বলেছি, আপনি বঙ্গবন্ধুর কাছে যা পেতেন, তা তাঁর কন্যার কাছে আশা করেন কেন? কন্যা বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যবহার করলে তিনিও তো আরেক বঙ্গবন্ধু হতেন। আমার ধারণা, এ বি এম মূসার মতো মুজিবভক্ত সাংবাদিকও হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের বিরূপ মন্তব্য করেন। হয়তো তা ব্যক্তিগত ক্ষোভের প্রকাশ। একটু সৌজন্যমূলক ব্যবহার দ্বারা প্রধানমন্ত্রী সহজেই মিত্রের শত্রু হওয়া নিবারণ করতে পারতেন। এই শত্রুতা এখন তাঁর কাছে গুরুত্বহীন মনে হতে পারে; কিন্তু দেশে যদি একটি নির্বাচন যথাসময়ে হয় তাহলে এই শত্রুতা ও মিত্রতার গুরুত্ব হতো, তখন তা উপলব্ধি করবেন। হয়তো তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে।
এবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিজে যেচে যে দেখা করতে চেয়েছিলাম (আগে কোনো দিন চাইনি), আগেই বলেছি, তার পেছনে ছিল আমার এলাকার জনগণের বিরাট একটি স্বার্থ। আজ ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বৃহত্তর বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলাটি মেঘনাগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। অসংখ্য হাটবাজার ভেঙে গেছে। জীবন-জীবিকার ওপর গভীর আঘাত পড়েছে। অবিলম্বে এই নদীভাঙন যদি রোধ করা না যায়, তাহলে আমাদের নিজেদের বাড়ি উলানিয়া গ্রামটিও সম্ভবত মেঘনাগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
দুর্ভাগ্যের কথা, এই এলাকার মানুষের হয়ে কথা বলার যোগ্য জনপ্রতিনিধি নেই। এই এলাকার সংসদ সদস্যের পদটি বহুকাল ধরেই বিএনপি দখল করে আছে। বিএনপির দলীয় চরিত্র অনুযায়ী এই সংসদ সদস্যরা কেবল নিজেদের স্বার্থ দেখেছেন; কিন্তু এলাকাবাসীর স্বার্থ দেখেননি। এখন আরো সুযোগ হয়েছে। বিএনপির এই সংসদ সদস্য এখন বলে বেড়াচ্ছেন, তিনি বিরোধীদলীয় এমপি হওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকার নদীর ভাঙন থেকে এ জনপদটি রক্ষায় কোনো সাহায্য-সমর্থন জোগাচ্ছে না।
উলানিয়া শুধু এই এলাকার নয়, গোটা বরিশালের একটি সমৃদ্ধ ও ঐতিহাসিক গ্রাম। দুই শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামটির অবস্থান একসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানকার জমিদারবাড়ি, বন্দর-বাজার, কয়েকটি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সারা এলাকার জনজীবনের সমৃদ্ধির সহায়ক। এখানকার জামে মসজিদটির তুল্য একটি মসজিদ সারা দেশে আছে কি না সন্দেহ। বিভাগপূর্ব সময় থেকেই এই গ্রাম দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
এই গ্রামের জমিদার বংশের একজন প্রয়াত সদস্য হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী খেলাফত ও বিয়ালি্লশের আগস্ট মুভমেন্টে কারাবরণ করেন এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। এই পরিবারের চৌধুরী মোহাম্মদ আরিফ বিভাগপূর্বকালে মুসলিম লীগ নেতা ও দীর্ঘকাল প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। খোরশেদ আলম চৌধুরী ছিলেন অবিভক্ত ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য এবং ফজলুল হক মন্ত্রিসভার হুইপ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন আমিনুল হক চৌধুরী এবং বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে বরিশাল জেলার গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। এই পরিবারের বাহাউদ্দিন চৌধুরী ঢাকায় আওয়ামী লীগের একসময়ের অন্যতম সংগঠক এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রথম আওয়ামী লীগের বৈঠকে ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপনকারী।
চৌধুরী মোহাম্মদ আরিফের কথা আগেই লিখেছি। তিনি মওলানা ভাসানী ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকে এই আরিফ চৌধুরী ওরফে ধনু মিয়ার তাঁতীবাজারের বাসায় বঙ্গবন্ধু কিছুদিন বাস করেন। বঙ্গবন্ধুর অর্ধসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এই আরিফ চৌধুরী ও বাহাউদ্দিন চৌধুরীর কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই পরিবারের প্রয়াত ফজলুর রহিম চৌধুরী ও নুরুল হক চৌধুরী ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক। ফজলুর রহিম চৌধুরী ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের একমাত্র জামাতা। উলানিয়া গ্রামে এসেছেন এমন সর্বভারতীয় নেতার সংখ্যা অনেক। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, বি আশা বেগম (মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর মা), শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, খান বাহাদুর হাশেম আলী খান, অশ্বিনী কুমার দত্ত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরো অনেকে। এই পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম নাট্যব্যক্তিত্ব আতিকুল হক চৌধুরী, কবি আসাদ চৌধুরী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ফুয়াদ চৌধুরী রয়েছেন।
শুধু পারিবারিক ঐতিহ্যের জন্য নয়, ঐতিহাসিক ও আর্থ-সামাজিক কারণেও এ অঞ্চলটিকে রক্ষা করতে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার এবং সেই আবেদন নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। তা পারিনি বলে আশাহত হয়েছি। তবে বন্ধুবর এ বি এম মূসার মতো ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হইনি। প্রধানমন্ত্রীর সময় কম। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাননি অথবা পারেননি; কিন্তু তাঁর বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী আমার আবেদন শুনে এই অঞ্চলটি রক্ষার ব্যাপারে যে আগ্রহ ও উৎসাহ দেখিয়েছেন, তাতে আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন (তিনি এরই মধ্যে এলাকাটি ঘুরেও এসেছেন) ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরাও। বিশেষ করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের ও সাময়িকভাবে হলেও ভাঙন রোধের যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাতে এলাকাবাসী তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। মাহবুবুর রহমান আমাকে সঙ্গে নিয়ে ভাঙনকবলিত এলাকায় যেতেও চেয়েছিলেন। আমার হঠাৎ অসুস্থতার জন্য তা হয়নি। মন্ত্রী শাজাহান খান ড্রেজিং ব্যবস্থা দ্বারা ভাঙন রোধের আপাতত ব্যবস্থা করার জন্য অত্যন্ত উৎসাহ দেখিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারিনি বলে আমি দুঃখিত নই। কারণ তাঁর মন্ত্রীদের যে সমর্থন ও সহযোগিতার আশ্বাস আমি পেয়েছি, তাতেই সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ।
বাংলাদেশ এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বর্তমান হাসিনা সরকারের অনুকূল নয়। এই সরকারের মিত্রবেশী শত্রুর সংখ্যাই বেশি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার একটি অনুরোধ, মিত্রবেশী শত্রু ও স্তাবকদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে তিনি যেন আগামী দিনের সুনামিকে ছোট চোখে না দেখেন। শত্রুর সংখ্যা না বাড়ান। এই সুনামি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সহায়ক হয়েছে। ২০১৪ সালে তা না-ও হতে পারে।
ঢাকা, ১৭ নভেম্বর ২০১২, শনিবার

No comments

Powered by Blogger.