সুফিয়া কামাল : অগ্রগণ্য নারী by সেলিনা হোসেন

কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন মনন ও সৃজনশীলতায় অগ্রগামী নারী। যে সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, নিজের সহজাত জ্ঞান ও মেধা দিয়ে সেই সময়কে অতিক্রম করেছিলেন এগিয়ে থাকা মানুষের শাণিত বোধে। যে বয়সে মানুষের বিবেচনা ও অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হয়, সে বয়সে তাঁর সময়কে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন মানবকল্যাণের প্রয়োজনে।
তাঁর রচিত 'একাত্তরের ডায়েরী' গ্রন্থ এই বিবেচনার সবটুকু প্রেরণা থেকে রচিত। ডায়েরির শুরু ডিসেম্বর ৩০, ১৯৭০ তারিখে। শেষ হয়েছে ডিসেম্বর ৩১, শুক্রবার। পুরো এক বছর সময়। তবে প্রতিদিনের দিনলিপি নয়। মাঝে মাঝে কিছু কিছু তারিখ বাদ দিয়ে লিখেছেন।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। দুর্যোগে বিপর্যস্ত মানুষের হাতে রিলিফ-সামগ্রী তুলে দিতে তিনি গিয়েছিলেন পটুয়াখালীর ধানখালীর চর এলাকায়। রিলিফ দিয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন ৮ জানুয়ারি।
সত্তরের জলোচ্ছ্বাসের পরে ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছিল আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বাঙালি নেতার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত ১ মার্চ ১৯৭১ গণপরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। ১ মার্চ, সোমবার রাত ১০টায় কবি লিখছেন 'বিক্ষুব্ধ বাংলা'। ভুট্টো সাহেব পরিষদে যোগ দেবেন না সিদ্ধান্তে পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি রইল। ১২টায় এ খবর প্রচারিত হওয়ায় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল।
এভাবে বিভিন্ন তারিখে তিনি দেশের পরিস্থিতির কথা নানাভাবে বর্ণনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের দলিল হিসেবে এই ডায়েরির তথ্য গবেষণার উপাদান হয়ে কাজ করবে।
ডায়েরির একটি বিশেষ দিক এই যে কোনো কোনো তারিখে তিনি শুধু একটি কবিতা লিখেছেন। একজন কবি এভাবেই নিজের প্রকাশ ঘটান। এপ্রিল ১, বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় তিনি লেখাটি শেষ করেছেন এভাবে : 'কারফিউ চলছে। প্লেনের আসা-যাওয়ার বিরাম নেই। কাল থেকে নাকি ব্যাঙ্ক সব খোলা হবে। আট আনায় তিনটি পান কিনলাম। বাংলার ইতিহাস কে রচনা করবে?' শেষের বাক্যটি অন্য বাক্যগুলোর চেয়ে ভিন্ন। কিন্তু কোনোভাবেই এটি কোনো আকস্মিক বাক্য নয়। কারণ ২৫শের রাতে গণহত্যার পর শুরু হয়ে গেছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হবে বাঙালির নতুন ইতিহাস। তিনি আহ্বান করছেন ইতিহাস রচয়িতাকে। এখানেই চিহ্নিত হয় তাঁর অগ্রগামী চিন্তার স্বরূপ।
ডিসেম্বর ১৬, বৃহস্পতিবার লিখছেন, "আজ ১২টায় বাংলাদেশ যুদ্ধ বিরতির পর মুক্তিফৌজ ঢাকার পথে পথে এসে আবার সোচ্চার হল 'জয় বাংলা' উচ্চারণে। আল্লাহর কাছে শোকর।"
ডিসেম্বর ২৯ তারিখে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটি শুরু হয়েছে নিজের মেয়ের কথা দিয়ে। লিখেছেন :
"আমার 'দুলু'র মুখ দেখি আজ বাংলার ঘরে ঘরে
শ্বেত বাস আর শূন্য দু'হাত নয়নে অশ্রু ঝরে..."
শেষ হয়েছে এ দুটি লাইন দিয়ে :
'সুন্দর কর মহামহীয়ান কর এ বাংলাদেশ
এই মুছিলাম অশ্রুর ধারা দুঃখের কেউ শেষ।'
কবিতাটি বেশ বড়। কষ্ট থেকে আশায় ফিরে এসেছেন তিনি।
ডায়েরি শেষ হয়েছে ডিসেম্বর ৩১, শুক্রবার। শেষ বাক্যটি লিখেছেন, '১৯৭১ আজ শেষ হয়ে গেল। জানি না, আগামী কালের দিন কিভাবে শুরু হবে।'
তিনি বিশাল প্রত্যাশায় তাকাননি আগামী দিনের দিকে। বরং খানিকটা দ্বিধা প্রকাশ করেছেন। স্বাধীনতার চলি্লশ বছরে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশে অনেক অপূর্ণতা এখনো রয়ে গেছে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.