ইসরায়েলি বর্বরতার শেষ কোথায়? by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

ফিলিস্তিন হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীনতম পবিত্র ভূমি। ফিলিস্তিনের মূল কেন্দ্র হচ্ছে জেরুজালেম। সেখানে রয়েছে হজরত দাউদ (আ.) এবং হজরত সোলায়মান (আ.) কর্তৃক নির্মিত পৃথিবীর প্রাচীন মসজিদ বায়তুল মোকাদ্দাস। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য নবীর (আ.) স্মৃতি এবং কবর।
সব ঐশী ধর্মের অনুসারীদের কাছে পবিত্র স্থান এ মসজিদ। ইসলামের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস থেকেই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বোরাকযোগে মেরাজ গমন করেছিলেন। দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের (রা.) সময় থেকে ফিলিস্তিন মুসলিম ভূখণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফিলিস্তিন দখলে নেয় ইহুদিরা। পরে সেখান থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে ইহুদি বসতি নির্মাণ করে ইসরায়েল। তাড়িয়ে দেওয়া ফিলিস্তিনিরা বিভিন্ন দেশে যুগের পর যুগ উদ্বাস্তু হিসেবে অমানবিক জীবনযাপন করছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনিদের আশঙ্কায় থাকতে হয়, যে কোনো মুহূর্তে ইসরায়েলি বোমা কিংবা বুলেটের আঘাতে তাদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হতে পারে। কথায় কথায় ইসরায়েল ফিলিস্তিনের পানি, বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস বন্ধ করে দেয়। ঠুনকো অজুহাতে রকেট নিক্ষেপ কিংবা বোমাবর্ষণ শুরু করে। মানবাধিকার, বিশ্ববিবেক ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি ইসরায়েল কোনো তোয়াক্কা না করেই এসব করে যাচ্ছে। ইসরায়েল মনে করে, ওই এলাকায় ইহুদি ছাড়া অন্য কোনো জাতির থাকার অধিকার নেই। ইসরায়েল বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব শেষ করার জন্য সব ধরনের পৈশাচিকতার আশ্রয় নিয়েছে। তাদের নির্যাতন ও নির্মমতা বেড়েই চলছে। আজ সময় এসেছে ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করার। বিবেকবান মানুষ সোচ্চার হলে ইসরায়েল তাদের নৃশংসতা থামাতে বাধ্য হবে। অবসান ঘটবে তাদের পৈশাচিকতা ও বর্বরতার।
হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যকার লাগাতার পারস্পরিক হামলা ও পাল্টা হামলা এবং এর গতি-পরিণতি বিষয়ে সবাই কমবেশি অবগত। গত সপ্তাহে ফিলিস্তিনের হামাস নিয়ন্ত্রিত এলাকা গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহতের সংখ্যা একশ' ছাড়িয়ে গেছে। আহত হয়েছে আট শতাধিক মানুষ। আকাশ ও নৌ হামলায় কোণঠাসা গাজায় নিহতদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। হামলা বন্ধে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যুদ্ধবিরতিতে উভয় পক্ষকে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন। এদিকে গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও গাজায় ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, হামলা-পাল্টা হামলা বন্ধ হলেও উত্তেজনার রেশ থেকেই যাচ্ছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের মূলে রয়েছে ভূমি দখলদারিত্ব থেকে মুক্তি অর্জন ও ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম-স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা প্রদান।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অজুহাত খাড়া করে গাজার বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংসে এগিয়েছেন। প্রতিবেশীদের অবরোধ ও সামরিক অভিযান না চালিয়ে ইসরায়েলের উচিত ছিল হামলার নোংরা চক্র থেকে বেরিয়ে এসে সমস্যা সমাধানের জন্য অর্থপূর্ণ সংলাপে বসার। তাতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পরিবেশ ফিরে আসত। ইসরায়েলিরা বলে, যুদ্ধ ইসরায়েল নয় বরং ফিলিস্তিন শুরু করে। নিজেদের বেসামরিক লোকজনের জীবন বাঁচাতে ইসরায়েল পাল্টা হামলায় নামে মাত্র। তাদের হামলার লক্ষ্য হলো সীমিত ও পরিমিত। বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ক্ষয়ক্ষতি ইসরায়েল চায় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি সশস্ত্র হামলা কোনো সময়েই সুনির্দিষ্ট পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকেনি এবং প্রতিটি হামলায় শিশু ও নারীসহ বেসামরিক ফিলিস্তিনি মারা গেছে। সত্য বলতে কি, ইন্তিফাদা শুরুর পর থেকে ফিলিস্তিনে লাগাতার বোমাবর্ষণ ও নিশানাভুক্ত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে ইসরায়েল। সহিংসতা ধীরে ধীরে জঘন্য চেহারা নিয়েছে। তবে অক্ষত থাকতে পারেনি ইসরায়েল নিজেও। প্রচুর ইসরায়েলিকেও মরতে হয়েছে ফিলিস্তিনিদের পাল্টা হামলায়।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের নজর এড়িয়ে যায়নি যে, ফিলিস্তিনি অবকাঠামো ইসরায়েল ধ্বংস করে যাচ্ছে রীতিমতো হিসাব-নিকাশ করে, ছক সাজিয়ে। ইসরায়েলি বোমা আঘাত হানছে গাজার সেতু, সড়ক এবং বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর। ফিলিস্তিনিদের উন্নয়ন প্রচেষ্টা নস্যাৎ এবং নৈরাজ্যের পথে তাদের ঠেলে দিতেই ভবিষ্যতের পথে গাজাবাসীর সব নির্মাণ উদ্যোগকে চুরমার করে দিচ্ছে ইসরায়েল। জেনেভা কনভেনশনে মৌলিক অবকাঠামোর ধ্বংস সাধনকে আইনবিরোধী বলা হয়েছে; তার প্রতিও ভ্রূক্ষেপ নেই ইসরায়েলের।
ইসরায়েলি বলদর্পিতা ও হঠকারিতার কারণেই কথিত সন্ত্রাসের পথে এগিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে হামাস। তাদের ঠেলে দিচ্ছে আত্মঘাতী বোমা হামলা ও যুদ্ধের পথে। আর এসব দেখেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ নীরব। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের নীরবতা খুবই রহস্যজনক। অন্যদিকে পশ্চিমের নেতাদের ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন ইসরায়েলকে আরও বেপরোয়া করে তুলছে। এখন কথা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের যে দৌড়ঝাঁপ এর পেছনে কি রয়েছে ব্যাপক মুসলিম নিধনের ইচ্ছা? আর যতক্ষণ না সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়, ততক্ষণ তারা মুখে বলবে এক আর কাজে
করবে অন্যটা!
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, একদিকে মিসরের মধ্যস্থতায় রকেট হামলা বন্ধে ফিলিস্তিনিদের রাজি করানোর চেষ্টা, অন্যদিকে আত্মরক্ষার কথা বলে ইসরায়েলি হামলার প্রতি সমর্থন জানানো_ পশ্চিমা নেতাদের পরস্পরবিরোধী এই অবস্থান মধ্যপ্রাচ্য সংকটকে আরও তীব্র করেছে। গাজায় যেভাবে যুগ যুগ ধরে ইসরায়েলি আগ্রাসন চলছে সেদিকে বিশ্ব নেতাদের নজর দেওয়া প্রয়োজন। যখন ইসলামের নামে সন্ত্রাস এবং বোমাবাজি হয়, তখন এ নিয়ে নিরন্তর লেখালেখি হয়, নেতাদের মুখে কথার ঝড় ওঠে, গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়। কিন্তু কোনো মুসলিম জনগোষ্ঠী কোথাও যখন নিপীড়িত কিংবা নির্যাতিত হয়, তখন এ নিয়ে খুব বেশি লেখা, আলোচনা ও প্রতিবাদ হয় না। বিষয়টি খুব হতাশাজনক।
নির্যাতিত ফিলিস্তিনি কিংবা মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে মানবতাবাদীদের এমন অনীহাবোধ কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। আশা করি, মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের মধ্যে 'মানবতাবাদী' প্রেরণাটুকু বেঁচে থাকুক সবসময়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে মানবতাবোধ জাগ্রত হোক, জয় হোক শান্তি ও মানবতার।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.