মোল্লা জুয়েল আটক, আপন ভুবনে পরাগ

শিশু পরাগ মণ্ডল অপহরণের ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে শুভাঢ্যা ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি আমিনুল ইসলাম ওরফে মোল্লা জুয়েলকে (৪৫) আটক করেছে পুলিশ। এর আগে প্রধান সন্দেহভাজন আমির হোসেন ও মোল্লা জুয়েলকে কেন গ্রেপ্তার করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট।
১১ নভেম্বরের শান্ত ভোরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা পশ্চিমপাড়ায় বাসার গলির মুখ থেকে বোন, মা আর গাড়িচালককে গুলি করে ছয় বছরের পরাগকে অপহরণ করেছিল সন্ত্রাসীরা। অপহরণকারীদের কাছ থেকে তিন দিন পর ছাড়া পেয়ে সে ১০ দিন ছিল হাসপাতালে। গত বুধবার সে বাড়ি ফেরে।
গতকাল দিনভর পরাগকে দেখতে আসে স্বজন-প্রতিবেশীরা। পরাগের দাদি ও অপহরণ মামলার বাদী সাবিত্রী মণ্ডল বলেন, পরাগ এমনিতে স্বাভাবিকই আছে। তবে অপরিচিত লোক দেখলে কিছুটা ভয় পাচ্ছে।
দাদির সঙ্গে কথা চলাকালে দুই বন্ধুর সঙ্গে ছোটাছুটি করতে করতে উঠানে এসে হাজির হয় পরাগ। হলুদ টি-শার্ট আর হাফপ্যান্ট পরা পরাগ বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিল। নিজে পুলিশ সেজে মুখ দিয়ে ঢাই-ঢুই শব্দ করে বন্ধুদের তেড়ে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে এক বন্ধুকে তেড়ে গিয়ে পরাগ বলে, ‘আরেকটু হলে গুন্ডাগুলোকে কুপোকাত করতে পারতাম। কিন্তু তারা আগেই আমার হাত দুটি ধরে ফেলেছিল।’ এভাবে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করে, কার্টুন দেখে দিন কেটেছে পরাগের। সে তার রিমোট-নিয়ন্ত্রিত গাড়িগুলো চালিয়েছে। পোষা গিনিপিগ নন্টে-ফন্টেকে খেতে দিয়েছে।
পরাগের দাদি বলেন, ‘বুধবার রাতে পরাগ গল্পচ্ছলে বলেছে, “লোকগুলো (অপহরণকারীরা) বলল, আমাকে স্কুলে পৌঁছে দেবে। এরপর মা আমাকে জড়িয়ে ধরে। লোকগুলো গুলি করে। মোটরসাইকেলে ওঠার পর মাথায় কিছু দিয়ে আঘাত করে। এরপর আর কিছু মনে নাই।”’
সাবিত্রী মণ্ডল বলেন, ‘পরাগের হাতে অনেকগুলো ইনজেকশনের দাগ দেখা গেছে। পরাগকে কোথায় রাখা হয়েছিল তা সে বলতে পারেনি। তবে সে বলেছে, একজন লোক তার কাছে ছিল। লোকটি তাকে বলেছে, এখানে বাঘ আছে। চিৎকার করলেই বাঘ ধরতে আসবে। তাকে কোনো কিছু খেতে দেওয়া হয়েছিল কি না, তাও বলতে পারেনি পরাগ। তবে বলেছে, তার মুখে জুসজাতীয় কিছু দেওয়া হয়েছিল।’
উদ্ধারের সময় পরাগের পরনে স্কুলের প্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি ছিল। তবে তার গায়ে থাকা স্কুল-ড্রেসের শার্টটি পাওয়া যায়নি।
হাইকোর্টের রুল: পরাগ অপহরণের ঘটনায় আমির হোসেন ও জুয়েলকে গ্রেপ্তারের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে গতকাল রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি ফরিদ আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক সম্পূরক আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে এ রুল জারি করেন।
স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকার জেলা প্রশাসক, র‌্যাবের মহাপরিচালক, ঢাকার পুলিশ কমিশনারসহ নয় বিবাদীকে এক সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ নভেম্বর পরাগ মণ্ডলের পরিবারকে নিরাপত্তা দেওয়ার নির্দেশের পাশাপাশি রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। আবেদনকারীর আইনজীবী মো. ইউনূস আলী আকন্দ গতকাল অপহরণের প্রধান সন্দেহভাজন আমির হোসেন ও জুয়েলকে গ্রেপ্তারের নির্দেশনা চেয়ে সম্পূরক আবেদন দাখিল করেন। শুনানি নিয়ে আদালত রুল জারি করেন। আবেদনের পক্ষে আইনজীবী ইউনূস আলী আকন্দ এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার শুনানি করেন।
মোল্লা জুয়েল আটক: গতকাল দুপুরে শুভাঢ্যার শমসেরপুল সড়কে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে মোল্লা জুয়েলকে আটক করে পুলিশ। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।
তবে ঢাকা জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, হাইকোর্টের নির্দেশে মোল্লা জুয়েলকে আটক করা হয়েছে। বিকেলে জুয়েলকে ঢাকা মহানগর ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়। সেখানেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
পরাগ অপহরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ডিবি একজনকে ও র‌্যাব ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে বলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে। এর বাইরে প্রধান সন্দেহভাজন আমির আলীর মোটরসাইকেলের চালক আল আমিন ও বন্ধু শাহীনকে গত মঙ্গলবার রাতে গোয়ালন্দ থেকে ডিবি আটক করেছে বলে নিশ্চিত করেছে ডিবি পুলিশ ও গোয়ালন্দ থানার একাধিক সূত্র। সবশেষে আটক করা হলো জুয়েলকে। জুয়েলের সঙ্গে পরাগের বাবা বিমল মণ্ডলের জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। পরাগ অপহরণের প্রধান সন্দেহভাজন আমিরের সঙ্গে জুয়েলের সম্পর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

No comments

Powered by Blogger.