জবান কো লাগাম দো শরিফোঁ by মোফাজ্জল করিম

ইদানীং চারপাশে খই ফোটার মতো খিস্তিখেউড় ফোটার শব্দ শুনতে শুনতে হঠাৎ মনে হলো, হিন্দি ছায়াছবির একটি প্রায়ই উচ্চারিত ডায়ালগকে এই কলামের কোনো লেখার 'থিম' বানালে কেমন হয়। ডায়ালগটি হচ্ছে : জবান কো লাগাম দো কমিনে।
ভেবে দেখলাম, কমিনে শব্দটি বাদ না দিলে কিল একটাও মাটিতে পড়বে না। আর যাঁদের নিয়ে লিখব, তাঁরা, তওবা তওবা, কমিনে হতে যাবেন কেন, তাঁরা তো অতি উঁচু স্তরের শরিফ লোক। অতএব? অতএব, কমিনে নয়, শরিফোঁ।
ডাক্তাররা বলেন, কারো শরীরে অতি মাত্রায় রক্তশূন্যতা বা 'সিভিয়ার অ্যানিমিয়া' দেখা দিলে তা তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আর আমাদের দেশের রাজনীতিতে মাত্রাতিরিক্ত শিষ্টাচারশূন্যতা এবং সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের তীব্র অভাবকে বলা যেতে পারে 'সিভিয়ার বিহেভিয়ারেল অ্যানিমিয়া ইন পলিটিকস'। এই অ্যানিমিয়ার কারণে বিভিন্ন দলের ভেতরে যত অস্থিরতা, উত্তেজনা ও যুদ্ধংদেহী ভাব। রোগীর কিন্তু ইতিমধ্যেই নাভিশ্বাস উঠে গেছে, যেকোনো মুহূর্তে ইন্না লিল্লাহ পড়তে হতে পারে। তখন আম ও ছালা- ম্যাঙ্গো অ্যান্ড দ্য গানি ব্যাগ- দুটোই হারাতে হবে। বিষয়টি নিয়ে হরহামেশা অনেক ওয়াজ-নসিহত আমরা শুনে থাকি, লেখালেখিও কম হয় না। কিন্তু অধার্মিক (এখানে প্রচলিত মূল শব্দটির ব্যবহার হবে শিষ্টাচার-বহির্ভূত!) না শোনে ধর্মের কাহিনী। শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা, বিনয়, সহনশীলতা ইত্যাদি জীবন থেকে যে হারে দ্রুত লোপ পাচ্ছে, তাতে আমাদের তরুণদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
মনে পড়ে আমাদের সময়ের (১৯৫৮-৬২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। সে আমলে ১৯৬০-এর দশকের শুরু পর্যন্ত তরুণসমাজের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে যে সংঘাত সৃষ্টি হতো না, তা নয়- সমাজে মতদ্বৈধ, মতবিরোধ তো থাকবেই, আগেও ছিল, এখনো আছে; কিন্তু এ কথা প্রবীণরা আশা করি স্বীকার করবেন, তখনকার তারুণ্য এত বারুদধর্মী ছিল না। যেকোনো ইস্যুতে দলাদলি, তর্কাতর্কি অবশ্যই ছিল; কিন্তু ওই পর্যন্তই। চট করে ছুরি চালানো, পিস্তল বের করা- এগুলো ছিল না। ছুরি, পিস্তল- এগুলোর আমদানি হয় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পোষ্য তথাকথিত ছাত্র নামধারী কিছু গুণ্ডার দ্বারা ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এসব সন্ত্রাসী মার্কা নেতা অচিরেই দৃশ্যপট থেকে বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু তাদের ছুরি-পিস্তল-বোমাগুলো রেখে যায় শিক্ষাঙ্গনে।
এখন যাঁরা রাজনীতির ময়দানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই সেই আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে, আমতলায়, মেডিক্যাল কলেজ-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ক্যান্টিনে অনেক তর্কযুদ্ধ করেছেন, টেবিল চাপড়িয়েছেন, আবার যুদ্ধ শেষে প্রতিপক্ষকে চায়ের দাম দিতে না দিয়ে নিজেই দিয়েছেন। হঠাৎ কালেভদ্রে কখনো একটু-আধটু হাতাহাতি হয়তো হতো, কিন্তু বড় রকমের মারামারি, ভাঙচুর- এগুলো ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত।

(২)
পাকিস্তানের জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জিন্নাহ সাহেব কিন্তু নিজের অজান্তেই বাঙালিদের একটা বড় উপকার করলেন : তিনি রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে একটিমাত্র নেতিবাচক ঘোষণা দিয়ে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ফেললেন, জাগিয়ে তুললেন তাদের ভেতর সহমর্মিতা, সহযোগিতার মনোভাব। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ঐক্য দারুণভাবে কাজে লাগল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা মানচিত্র পেলাম, নতুন পতাকা পেলাম, ঢাকা শহর রাজধানী হলো, সঙ্গে বোনাস হিসেবে পাওয়া গেল ছোটবড় নানা আকৃতির, নানা বর্ণ ও স্বাদের অসংখ্য নেতা; কিন্তু দুঃখের বিষয়, পেলাম না শুধু সেই আগের আমলের রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। যুদ্ধে গেলাম এই গুণাবলি সঙ্গে নিয়ে; ফিরে এলাম এগুলো ছাড়াই। এগুলোও কি তাহলে শহীদ হয়ে গেল যুদ্ধক্ষেত্রে?
অথচ আমাদের জাতীয় নেতাদের মধ্যে কখনো এই শিষ্টাচার ও মহানুভবতার অভাব দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধু নিজে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ স্থাপন করে গেছেন। যাঁরা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে শত্রুতুল্য প্রতিপক্ষ ছিলেন, শুনেছি তাঁদেরও খোঁজখবর নিতেন, কুশলাদি জানতে চাইতেন তিনি। এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও। এতে নিশ্চয়ই তিনি রাজাকার হয়ে যাননি, বরং তাঁর মহানুভবতার পরিচয় পেয়ে মানুষ মুগ্ধ হয়েছে। আর এখন ভিন্ন মাজহাবের কেউ মারা গেলেও সমবেদনা জানিয়ে একটা শোকবার্তা পাঠানো হয় না। এ রকম সিমারের মতো আচরণ বাংলাদেশে কেউ কোনো দিন দেখেছে? কী ঐতিহ্য বিনির্মাণ করছি আমরা আমাদের উত্তরসূরিদের জন্য?

(৩)
মধ্যবিত্ত বাঙালি-জীবনের অনেক কষ্টের মধ্যে একটি বিশেষ কষ্টের কথা বলি এবার। আগে যে আমলে টেলিভিশন, আকাশ-সংস্কৃতি, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদির নামও শোনেনি মানুষ, সে আমলে এ দেশের শিশুরা আদব-কায়দা, লেহাজ-তমিজ শিখত পরিবারের বড়দের কাছ থেকে। বড়দের একটা বড় দায়িত্বই ছিল ছোটদের স্বভাব-চরিত্র গঠনের দিকে লক্ষ রাখা, তাদের কথাবার্তা, চালচলন, মেলামেশা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনগুলো শ্রদ্ধাভরে মেনে চলার শিক্ষা দেওয়া। একজন দায়িত্বশীল, চরিত্রবান মুরব্বি- তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিংবা সামাজিক অবস্থান যা-ই হোক না কেন- ছিলেন সেই পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যদের জন্য রোল মডেল। তিনি নিজের কথাবার্তা, চালচলনে ছিলেন সদাসতর্ক। কারণ তিনি জানতেন, তাঁর ত্রুটি-বিচ্যুতি, স্বেচ্ছাচারিতার আছর পড়বে পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত নবীনরা তাঁকে মহাজ্ঞানী-মহাজন মনে করে তাঁর পথে গমন করতে প্রণোদিত বোধ করবে। তিনি সৎভাবে জীবন যাপন করলে তারাও তাঁর সৎ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে জীবনে সৎপথে চলবে। তিনি যদি ম এবং ম-কারান্ত বিষয়াদিতে আসক্ত হয়ে পড়েন, তাহলে তারাও ওই পথেই ধাবিত হবে।
বাঙালি সমাজের আবহমান কালের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ছিল একটি তরুণের চরিত্র গঠনের নিয়ামক শক্তি। এতে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিত না, অস্থিরতা ছিল অনুপস্থিত। কিন্তু যখনই বাঙালি জীবনের সুস্থির সরসীনীরে স্বাভাবিক নিয়মেই আধুনিক বিশ্বের প্রযুক্তির লোষ্ট্রখণ্ডগুলো এসে টুপটাপ করে পড়তে লাগল, খোলা জানালা দিয়ে বিশুদ্ধ বায়ুর সঙ্গে কিছু পূতিগন্ধময় দূষিত বাতাসও ঢুকে পড়ল, তখনই বাঙালি তার মোমের আলোর মতো শান্ত-স্নিগ্ধ সাংস্কৃতিক রূপটি ঝেড়ে ফেলে, মাম্মি-ড্যাডিকে টা টা বাই বাই জানিয়ে, পাশের বাড়ির প্রতিবেশীকে হ্যালো আংকেল, হাই আন্টি বলে তাদের আধুনিকা কন্যাটিকে নিয়ে ঢাকার রাস্তায় বাপ-চাচাদের নাকের ডগায় হাত ধরাধরি করে ঘুরতে ঘুরতে, ভার্সিটি চত্বরে, পার্কেপুর্কে প্রকাশ্যে লৎকালৎকি করতে করতে বিদেশি সংস্কৃতিতে একেবারে ডাবল-ট্রিপল অটোপ্রমোশন নিয়ে নিল। বাতিল খবরের কাগজের মতো ঘরের কোণে 'রোলড্' হয়ে ল্যাদা মেরে পড়ে থাকা কোনো রোল মডেল প্রাচীন মুরব্বিকে আর কষ্ট করে এই প্রজন্মকে আদব-কায়দার সবক দিতে হয় না; সে দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে টিভির রকমারি স্যাটেলাইট চ্যানেল ও ইন্টারনেট নামক আলাদিনের জাদুই চেরাগ।... মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে যে বিশেষ কষ্টের কথা বলছিলাম এটাই সে কষ্ট।

(৪)
এ তো গেল বাঙালির নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে বনবাসে পাঠিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতিকে নিয়ে ঘর বাঁধার কষ্টের কথা। আরেকটা গোপন কষ্ট আছে বাংলাদেশের সব মানুষের মনে। তারা বড় আশা করে, তাদের নেতা-নেত্রীরা দলমত-নির্বিশেষে পরস্পরের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলবেন, একজনের বাড়িতে আরেকজন যাবেন, পান-তামাক খাবেন, রাস্তাঘাটে দেখা হলে শরীর-স্বাস্থ্য, জমিজিরাত, মামলা-মোকদ্দমার খবর নেবেন, ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিরা কেমন আছে জানতে চাইবেন ইত্যাদি। দুই ঈদে যখন তারা দেখে তাদের শীর্ষ নেতারা একে অন্যকে ঈদকার্ড পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন বাহক মারফত, তখন তাদের কল্পনার পায়রা ডানা মেলে : ইস্, যদি একজনের বাড়িতে আরেকজন সেমাই খেতে যেতেন, এক দলের লোকেরা জিয়াফত খেতে যেতেন আরেক দলের বাড়িতে। আর এটা হবে না-ই বা কেন? রাজনীতিতে একে অন্যের বিরোধিতা করা মানেই তো একজন সাপ, আরেকজন বেজি হয়ে যাওয়া নয়। ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতাকে পাশাপাশি বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে, হাসাহাসি করতে দেখেছি আমি, যখন ওই দেশে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলাম তখন। এমন উদাহরণ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আছে। শুধু আমরাই বোধ হয় একমাত্র ব্যতিক্রম। সেদিন অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিভিন্ন পর্যায়ে বারাক ওবামা ও মিট রমনির পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও শিষ্টাচার, বিশেষ করে নির্বাচনোত্তর বক্তব্যগুলো থেকে কি আমাদের কিছুই শেখার নেই?
(এর ভেতর আবার পাবলিকে যখন দেখে 'এ' দলের নেতার ছেলের সঙ্গে 'বি' দলের নেতার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে- অ্যান্ড ভাইস ভার্সা- তখন হিসাব মেলাতে পারে না তারা, দার্শনিকের মতো শুধু বলে : বড়লোকদের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা। সবই তাঁর ইচ্ছা।)
আজকালকার ছেলেমেয়েদের চালচলন যেমন বদলে গেছে, তেমনি বদলে গেছে বড়দের রাজনৈতিক কালচার। ভব্যতা-সভ্যতার আবহমান কালের মানদণ্ড ভেঙে নবীন-প্রবীণরা কে যে কাকে টপকে যাচ্ছেন বলা মুশকিল। নবীনরা যদি বলে, আমাদের চালচলনে আপনারা প্রাণের স্পন্দন নয়, শুধু বেলেল্লাপনাই দেখেন, আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আমরা এখন একজন আরেকজনকে বন্ধুত্বের অন্তরঙ্গতায় তুই বলে সম্বোধন করি দেখে আপনারা 'গেল গেল' বলে আহাজারি করেন, কিন্তু আপনারা যখন টিভির টক শোতে লাখ লাখ দর্শকের সামনে তুই-তোকারি করে একজন আরেকজনকে শুধু আক্রমণই নয়, রীতিমতো মারতে তেড়ে আসেন, বক্তৃতার মঞ্চে এমন ভাষায় ধোলাই দেন প্রতিপক্ষকে যে শুনে ধোলাইখাল বস্তির ঠেলাওয়ালা লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নেয়, কেউ কেউ আবার কথায় কথায় জনসমক্ষে ইংরেজিতে স্টুপিড, ইডিয়ট, ননসেন্স, রাবিশ ছাড়া গাল দিয়ে সুখ পান না, তখন আমাদের কোন গল্পটা মনে পড়ে যায় জানেন? 'কোন গল্পটা?' শুনুন তাহলে। আপনাদের মতো দুই মুরব্বির মধ্যে তুমুল ঝগড়া হচ্ছিল। একপর্যায়ে এক তরুণ যুবক এসে ওদের থামিয়ে দিয়ে বলল, চাচা মিয়ারা, আপনারা যা নিয়া ঝগড়া করতাছেন তার ফয়সালার জন্য ওই যে বইয়া রইছে ইনসাফ আলী দাদা, তার কাছে যান না ক্যাঁ? রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দুজন গেল বুড়ো ইনসাফ দাদার কাছে। শুরুতেই বুড়ো ওদের একজনের কাছে জানতে চাইল কী নিয়ে ঝগড়া। সে বলল, এই শুয়োরের বাচ্চা...। বুড়ো সঙ্গে সঙ্গে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনি থামেন। দেখি, আপনি বলেন তো সমস্যাটা কী। বলে তাকাল অন্যজনের দিকে। ওই লোক শুরু করল, এই কুত্তার বাচ্চা...। বুড়ো একেও থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনাদের দুজনেরই পিতৃপরিচয় পেলাম। এবার বলুন, ঝগড়া করছেন কেন?

(৫)
শ্রদ্ধেয় রাজনীতিকরা, আপনাদের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, আপনারা গালাগালি-গলাগলি-ঢলাঢলি, মারামারি-ছোরাছুরি-চোরাচুরি যা-ই করুন না কেন, প্লিজ, মনে রাখবেন, আপনার ছেলেটি, মেয়েটি, ভাতিজা, ভাতিজিটি, নাতিটি কিন্তু আপনার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আপনি রাজনীতিতে যে সংস্কৃতির চর্চা করছেন, দুই দিন পর এই তরুণ-তরুণীরা যখন আপনার স্থলাভিষিক্ত হবে, তখন তারাও এটাকেই রাজনীতির রেওয়াজ মনে করে এই একই পথে চলবে, একই ভাষায় কথা বলবে, একই কায়দায় (হয়তো উন্নত ডিজিটাল কৌশল প্রয়োগ করে) দুর্নীতিতে লিপ্ত হবে। আপনি কি তা-ই চান? আপনি হয়তো কপালগুণে কিংবা একে-ওকে ম্যানেজ করে পার পেয়ে যাবেন, কিন্তু আপনার সন্তানটিও যে উতরে যাবে, তার নিশ্চয়তা কী আছে? দশ দিন 'হলমার্কের', এক দিন র‌্যাবের-দুদকের- এটাই তো 'ডেসটিনি'!
আমাদের শ্রদ্ধেয় নমস্য নেতারা কথা বলার সময় যখন তাঁদের মুখ দিয়ে বালসুলভ দায়িত্বহীন বেফাঁস বাক্য নিঃসৃত হয়, তখন আমাদের সিলেট অঞ্চলের একটা গ্রাম্য শ্লোক মনে পড়ে যায় আমার : চামড়ার মুখ লড়খড়া (নড়বড়ে), মাত্ (কথা) যায় গিয়া ত্যাড়াবেড়া।... গ্রাম্য শ্লোক গ্রামের অশিক্ষিত, মূর্খ গরিবদের বেলা প্রযোজ্য হতে পারে, কিন্তু আপনারা? কাঁহা রাজা ভোজ, আর কাঁহা গঙ্গারাম তেলী।

(৬)
আমার নিজের জীবনের একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলে শেষ করি। ২০০৫ সালে লন্ডনে হাইকমিশনার থাকাকালে একদিন কুলাউড়া থেকে আমার এক আত্মীয় ফোন করল : বাইছাব, হুনছইননি? অমুকর হার্ট অ্যাটাক অইছে। অবস্তা বেশি বালা নায়। যার সম্বন্ধে আমার আত্মীয় সংবাদটি দিল, সেই অপেক্ষাকৃত তরুণ ব্যক্তিটি আমাদের দলের স্থানীয় রাজনীতিতে ছিল আমার প্রবল প্রতিপক্ষ। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল বললে সত্যের অপলাপ হবে। বরং সত্য হলো, অহেতুক নানাভাবে সে আমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এই ম্যাকিয়াভেলিয়ান ক্যারেক্টারটির প্রধান আপত্তি ছিল, আমি কেন রাজনীতিতে যোগদান করে, তার চিন্তায়, তার বাড়া ভাতে ছাই দিতে এলাম। যা হোক, সেদিন টেলিফোনটা রেখেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটা চিঠি লিখে আমি আমার গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়ে তার আশু রোগমুক্তি কামনা করলাম এবং চিঠির শেষে জুড়ে দিলাম : একটু সুস্থ বোধ করলে তুমি সোজা লন্ডনে চলে এসো। আমার বাসায় থাকবে তুমি। এখানে তোমার উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে। চিঠিটি সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাঙ্ করে পাঠিয়ে দিলাম তার কাছে। এর পরের ঘটনা বেশ চমকপ্রদ। শুনলাম, চিঠির প্রাপক নাকি অনেকের কাছে ওটার কপি দিয়ে বলে বেড়াচ্ছে, এই দেখুন, সচিব সাহেব (এই নামেই আমাদের এলাকায় লোকে আমাকে ডাকে) সারেন্ডার করেছেন আমার কাছে। তিনি এই আসনে আগামীতে আমাকেই প্রার্থী হিসেবে চান।
আর জেলা পর্যায়ের একই দলের অন্য এক প্রতাপশালী নেতা, যিনি সেই তরুণকে সহ্য করতে পারতেন না, টেলিফোনে আমাকে খুব ঝাড়লেন- কেন আমি ওই...(অশ্লীল গালি)কে এ ধরনের চিঠি লিখলাম। 'দ্য বা...র্ড ডাজ নট ডিজার্ভ ইট', রাগে গজগজ করতে করতে বললেন তিনি। ...'আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে...।'
আমাদের দেশের রাজনীতিতে ভদ্রতা, শিষ্টতা, বিনয় ও পরমতসহিষ্ণুতার সুবাতাস কবে বইবে, প্রভু?

লেখক : সাবেক সচিব, কবি

No comments

Powered by Blogger.