ধর্ম- মহররম চান্দ্রমাসে আশুরার রোজা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

হিজরি নববর্ষে মহররম চান্দ্রমাসটি পুরোনো বছরের জরাজীর্ণতাকে মুছে দিয়ে ইসলামের ইতিহাসকে জানার, মুসলিম ঐতিহ্যকে চেনার ও দুরন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ত্যাগ-তিতিক্ষায় নির্ভীক পথচলার কল্যাণময় শুভবার্তা নিয়ে ফিরে আসে। ‘মহররম’ শব্দের অর্থ অলঙ্ঘনীয় পবিত্র।
ইসলামে মহররম মাসটি অত্যন্ত ফজিলতময় ও মর্যাদাপূর্ণ। এ মাসেই বহু নবী-রাসুল ইমানের কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে মুক্তি ও নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। অসংখ্য তথ্যবহুল ঐতিহাসিক ঘটনা এ মাসে সংঘটিত হয়েছিল। পবিত্র আশুরার সঙ্গে পুরো মহররম মাসের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা চারটি মাসে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ হারাম ঘোষণা করেছেন; যেসব অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাসে ঝগড়া-বিবাদ, যুদ্ধবিগ্রহ একেবারে নিষিদ্ধ, সেই সম্মানিত মাসের অন্যতম মহররম মাস। অন্য তিনটি মাস হলো: রজব, জিলকদ ও জিলহজ। এ মাসগুলোতে যুদ্ধ করা মহাপাপ। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাস গণনায় মাস ১২টি, তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত, এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩৬)
প্রাচীনকাল থেকে আরব দেশে চারটি মাস পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হতো। এ মাসগুলোতে যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি, মারামারি, লুটতরাজ প্রভৃতি থেকে বিরত থাকার নিয়ম প্রচলিত ছিল। একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) ১০ মহররম আশুরার তাৎপর্য বর্ণনাকালে সাহাবায়ে কিরাম বিনীত আরজ করলেন, ‘তবে কি আল্লাহ তাআলা ওই দিনটিকে সব দিনের চেয়ে অধিক মর্যাদা দিয়েছেন? নবী করিম (সা.) জবাব দিলেন, হ্যাঁ!’ এরপর তিনি ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাআলা আসমান, জমিন, লওহ-কলম, সাগর, পর্বত এদিনে সৃষ্টি করেছেন।’
ইহজগতের সৃষ্টি, হজরত আদম (আ.)-এর খলিফা হিসেবে দুনিয়াতে আগমন এবং এদিনেই তাঁর তওবা কবুল হওয়া, হজরত নূহ (আ.)-এর নৌকা ঝড়-তুফানের কবল থেকে পরিত্রাণ পাওয়া, হজরত আইয়ুব (আ.)-এর কঠিন পীড়া থেকে মুক্তি এবং হজরত ঈসা (আ.)-এর আকাশে জীবিতাবস্থায় উত্থিত হওয়াসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মহররমের ১০ তারিখ আশুরা একটি মর্যাদাপূর্ণ দিবস হিসেবে যুগ যুগ ধরে চিরস্মরণীয়। সর্বোপরি এ পৃথিবীর মহাপ্রলয় বা কিয়ামত মহররমের ১০ তারিখ ঘটবে বলে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।
নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার রোজা রাখে তার আমলনামায় সাত আসমান জমিনের সব অধিবাসীর সওয়াব লেখা হয় এবং যে ব্যক্তি নিজের জন্য দোজখের আগুন হারাম করতে চায়, সে যেন মহররম মাসের নফল রোজা রাখে।’ অন্য একটি হাদিস থেকে জানা যায়, ‘মহররম মাসে যদি কোনো ব্যক্তি রোজা রাখে, তবে প্রত্যেক রোজার পরিবর্তে ৩০ রোজার পুণ্য লাভ করবে।’
ইসলাম-পূর্বকালে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায় নানা কারণে পবিত্র আশুরার দিন রোজা রাখত। মহররমের ১০ তারিখ আশুরার ফজিলত সম্পর্কে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করে দেখতে পেলেন যে ইহুদিরা আশুরা দিবসে রোজা রাখছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কোন দিন যাতে তোমরা রোজা রেখেছ?’ তারা বলল, এটা এমন এক মহান দিবস, যেদিন আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন, ফেরাউনকে তার সম্প্রদায়সহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তাই হজরত মুসা (আ.) শুকরিয়া হিসেবে এদিন রোজা রেখেছেন, এ জন্য আমরাও রোজা রাখি। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমাদের চেয়ে আমরা হজরত মুসা (আ.)-এর অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) রোজা রাখলেন এবং অন্যদের রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)
প্রাক-ইসলামি যুগে মক্কার কুরাইশরা আশুরার দিনে রোজা রাখত। নবী করিম (সা.) বাকি জীবনে এদিন রোজা রাখতেন। মদিনায় হিজরতের পর রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পরে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমি আশুরার দিন রোজা রাখতে আদিষ্ট ছিলাম, অতএব এখন তোমাদের কারও যদি ওই দিন রোজা রাখতে ইচ্ছা হয়, তবে তা রাখতে পারো।’ আশুরার দিন রোজা রাখলে ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য হয়ে যায় বিধায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর আগের দিন বা পরের দিন আরেকটি নফল রোজা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুমিন মুসলমানেরা ১০ মহররম আশুরা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে এদিন ঐচ্ছিক রোজাব্রত পালন করেন। আশুরার দিন নফল রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘এই রোজা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা হয়ে থাকে।’
প্রকৃতপক্ষে মহররম মাসটি পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, নামাজ-রোজা, জিকির-আসকার, দান-সাদকা প্রভৃতি ইবাদতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আশুরার দিনে নফল ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে জান্নাত লাভ থেকে শুরু করে সওয়াব হাসিলের অনেক সুযোগ রয়েছে। এদিন যদি কোনো মুসলমানকে পেটপুরে আহার করান, তবে তিনি নবী করিম (সা.)-এর সব উম্মতকে পেটপুরে আহার করানোর সমান সওয়াব পাবেন। এ পবিত্র মাসের সম্মান প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যে ব্যক্তি মহররম মাসের সম্মান করবে, আল্লাহ তাকে বেহেশতে সম্মানিত করবেন এবং জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্ত রাখবেন।’
আসুন, আল্লাহর দরবারে আকুল প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে পবিত্র মহররম মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুধাবন করে আশুরার নফল রোজা পালনসহ ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অশেষ সওয়াব হাসিলের তাওফিক দান করেন এবং সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক কারবালার মর্মস্পর্শী কাহিনি স্মরণে প্রত্যেক মুসলমানকে ইমানি শক্তিতে আরও বেশি বলীয়ান ও তেজোদীপ্ত হওয়ার মানসিকতা দান করেন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dৎ.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.