আতঙ্ক কাটেনি পরাগের-জুয়েল মোল্লা আটক - আমিরের খোঁজ নেই

শিশু পরাগ অপহরণ ঘটনার মূল সন্দেহভাজন সাবেক যুবলীগ নেতা আমিনুল হক জুয়েল ওরফে জুয়েল মোল্লাকে অবশেষে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যার চুনকুটিয়া এলাকা থেকে জুয়েলকে আটক করা হয়।
পরাগ অপহরণ ঘটনায় যুবলীগ নেতা জুয়েল ও আমির হোসেনকে গ্রেপ্তারের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে গতকাল একটি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এর পরই জুয়েলকে আটক করা হলো।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, শুভাঢ্যা ইউনিয়নের সাবেক যুবলীগ সভাপতি জুয়েলকে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সেখানে পরাগ অপহরণ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করতে জড়িত অন্য ব্যক্তিদের তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। অপহরণকারী দলের প্রধান আমিরের সহযোগী আল আমিনকে গত মঙ্গলবার রাতে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে আটক করার পর অন্য সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের খোঁজে মাঠে নামে ডিবি। আমিরকে গ্রেপ্তারেও চলছে অভিযান। গতকাল পর্যন্ত আমির ও আল আমিনকে আটকের ব্যাপারে কোনো তথ্য জানাননি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। পরাগ অপহরণ ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তারের পর জুয়েলসহ তিনজন আটকের খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে পরাগের স্বজনরা গতকাল বলেছেন, শিশুটি শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও ভয় এখনো পুরোপুরি কাটেনি। মোটরসাইকেলের শব্দ শুনলেই সে চমকে ওঠে।
গতকাল ডিবির সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন জুয়েল মোল্লাকে আটকের খবরের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, 'তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে আমির ও জুয়েলের সম্পৃক্ততা আছে কি না তাও যাচাই করা হচ্ছে।' শুরু থেকেই থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন। জুয়েলকে কি গ্রেপ্তার দেখানো হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হওয়ার আগে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা পূর্বপাড়ার চুনকুটিয়া শমসেরপুল সড়কের পাশে জুয়েলদের বাসা সেলিনা কটেজ। গতকাল বিকেলে বাসায় গেলে স্বজনরা জানান, জুয়েল বাড়ির পাশেই ইনসাফ টাওয়ারের চতুর্থ তলায় নিজ অফিসে ছিল। দুপুরে সাদা পোশাকে ডিবি ও থানা পুলিশের সদস্যরা এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। জুয়েলের ছোট ভাই জহিরুল ইসলাম জামান, বড় বোন নাসিমা আক্তার সাথী, স্ত্রী শারমিন সুলতানা ও ব্যবসায়িক সহকারী নূর মোহাম্মদ সবাই দাবি করেন জুয়েল নির্দোষ। দুপুর ১টার কিছু আগে সাতজন পুলিশ এসে জুয়েলকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। স্বজনরা যুক্তি দেখান, পরাগ অপহরণ ঘটনার জড়িত থাকলে জুয়েল এলাকায় থাকত না। স্থানীয় প্রতিপক্ষ সাংবাদিকদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে বলে দাবি স্বজনদের।
ডিবি সূত্র জানায়, মঙ্গলবার রাতে গোয়েন্দা পুলিশ রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে পরাগ অপহরণ মামলার মূল হোতা সন্ত্রাসী আমিরের সহযোগী আল আমিন ও তার বন্ধু শাহিনকে আটক করে। এরপর আমিরকে গ্রেপ্তারে চট্টগ্রামে অভিযান চালানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জুয়েলকেও আটক করার সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। গতকাল আমির ও জুয়েলকে গ্রেপ্তার করতে হাইকোর্ট রুল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জুয়েলকে আটক করে ডিবি।
রাজধানীর উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জ থেকে শিশু পরাগকে অপহরণের পর শোনা যায়, পরাগের বাবা বিমল মণ্ডলের সঙ্গে সম্প্রতি একটি জমি নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে জুয়েল মোল্লা। অপহরণের পরপর জুয়েলকে কেউ এলাকায় দেখেনি। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার নাম সন্দেহভাজন হিসেবে উঠে এলে ঘটনার পাঁচ দিন পর জুয়েলকে এলাকায় দেখা যায়। দুটি হত্যা মামলাসহ আটটি মামলার আসামি জুয়েল তখন কালের কণ্ঠকে বলেছিল, সে ষড়যন্ত্রের শিকার; আমির ও অন্য সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই।
সূত্র জানায়, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা এলাকার চুনকুটিয়া চৌরাস্তার পাশে জামিয়া আরাবিয়া চানমিয়া ওহাবুল উলুম মাদ্রাসার পাশেই আমিনুল হক জুয়েল ওরফে মোল্লা জুয়েলের বাড়ি। তার বাবার নাম ফিরোজ মোল্লা। চারদলীয় জোট সরকারের সময় জুয়েল বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। জোট সরকারের প্রভাব খাটিয়ে অর্থবিত্তের মালিক হয় সে। এর আগে জুয়েল জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল বলেও শোনা গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে শুভাঢ্যা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হয় জুয়েল। স্বপন হত্যা মামলায় আসামি হওয়ার পর তাকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
পরাগ অপহরণের ঘটনায় গত ১৪ নভেম্বর র‌্যাব জাহিদুল হাসান, মোহাম্মদ আলী রিফাত, কালাচান, আবুল কাশেম, রিজভী আহম্মেদ অনিক ও আফজাল হোসেন নামে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। একই দিন মামুন নামে এক আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জাহিদুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী রিফাত, মো. কালাচান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এ ছাড়া আবুল কাশেম, রিজভী আহম্মেদ অনিক ও আফজাল হোসেন ও মামুন পুলিশ রিমান্ডে আছে।
গত ১১ নভেম্বর সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা পশ্চিমপাড়ার বাসার সামনে থেকে নিজেদের প্রাইভেট কারে ওঠার সময় মা লিপি মণ্ডল, বোন পিনাকী মণ্ডল ও গাড়িচালক নজরুলকে গুলি করে ছয় বছরের শিশু পরাগ মণ্ডলকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরাগ সদরঘাটের হীড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে কেজি ওয়ানের ছাত্র। গত ১৩ নভেম্বর রাতে কেরানীগঞ্জের আটিবাজার এলাকা থেকে অচেতন অবস্থায় পরাগকে উদ্ধার করে তার বাবা বিমল মণ্ডল। পরাগকে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে অপহরণকারীরা ছেড়ে দিয়েছে বলে র‌্যাব জানিয়েছে।
পরাগের ভয় কাটেনি : গতকাল পরাগদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শিশুটির বিছানায় অনেক খেলনা। আছে খেলনা গাড়ি, বল ও বাক্স। টেলিভিশনে চলছে কার্টুন চ্যানেলের নাটক ডোরেমন। বিছানার চারপাশে ভিড়। মাঝখানে পরাগ। এসব কিছুতেই যেন তার মন বসছে না। একবার খেলছে, আবার চুপসে যাচ্ছে। খেলনা গাড়ির একটি বাক্স থেকে সে বের করল দুটি ছোট সাদা ইঁদুর। বিস্ময়ে সবাই ঝুঁকে দেখছে সেগুলো। এসব কী, জানতে চাইলে পরাগের উত্তর- 'নন্টেফন্টে'। এরপর নন্টেফন্টেকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটল পরাগের। গতকাল বৃহস্পতিবার কেরানীগঞ্জের পশ্চিমপাড়ায় বাড়িতে দাদির কক্ষে অপহৃত শিশু পরাগ মণ্ডলকে এভাবেই দেখেছে অনেকে।
পরাগের স্বজনরা কালের কণ্ঠকে বলেন, পরাগ শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও এখনো আতঙ্ক কাটেনি তার। বাড়িতে আসা মোটরসাইকেলের শব্দ শুনেও ভয় পাচ্ছে পরাগ। সে দাদি সাবিত্রী মণ্ডলকে জড়িয়ে ধরে বলে, 'ঠাকুরমা, মোটরসাইকেল আসে।' তবে স্বজনরা পরাগকে সম্পূর্ণ মানসিক চাপমুক্ত রাখার চেষ্টা করছেন বলে জানান। সে যা চাইছে, তাই জোগাড় করে দেওয়া হচ্ছে। অপহরণ ও অপহরণ-পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে পরাগকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছেন না। তবে মেধাবী পরাগ স্বজনদের জানিয়েছে তাকে কিভাবে রাখা হয়েছিল এবং কিভাবে ভয় দেখানো হয়েছিল সেসব কথা।
পরাগের দাদি সাবিত্রী মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, "পরাগ এখনো ভয় পাচ্ছে। মোটরসাইকেলের শব্দ শুনলেই ও আমার কাছে আসে। বলে, 'ঠাকুরমা, মোটরসাইকেল আসে'।" স্বজনরা জানান, পরাগ কথায় কথায় তাদের অনেক কিছু বলেছে। মোটরসাইকেলে তোলার পরই অপহরণকারীরা তাকে ইনজেকশন দেয়। পরে ঘুম থেকে উঠে পরাগ দেখে, সে একটি অপরিচিত বাসায়। সেখানে তিন-চারজন মানুষ। কান্না শুরু করলেই ওরা তাকে ভয় দেখাত : 'বাঘ আছে, বাঘে ধরবে।' এরপর ইনজেকশন দেওয়া হতো পরাগকে।
পরাগের গুলিবিদ্ধ বোন সাবিত্রী মণ্ডল বলে, 'ওরা নাকি গ্রেপ্তার হয়েছে? আমরা শয়তানগুলোর বিচার চাই।' গ্রেপ্তার হওয়া কাউকে শনাক্ত করতে পেরেছে কি না জানতে চাইলে পিনাকী বলে, 'পত্রিকায় ছবি দেখেছি। কিন্তু ঘটনার সময় ওদের মাথায় হেলমেট ছিল। তাই বুঝতে পারছি না। একজনের চুল বড় ছিল।' পরাগের মামা অনিন্দ্য সরকার বিদ্যুৎ জানান, ঘটনা ভুলে যেতে সহায়তার জন্যই চিকিৎসকরা বলেছেন পরাগকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করতে। পরাগ লিখতে পারে। পুলিশ পরাগকে একটি ডায়েরি দিয়েছে। সেখানে সে যদি কিছু লেখে বা আঁকে। তবে পরাগ সেখানে কিছু লেখেনি।
স্বজনরা আরো জানান, অন্তত এক সপ্তাহ স্কুলে যাওয়া হবে না পরাগের। এদিকে গতকাল বাড়িতে পাওয়া যায়নি পরাগের বাবা বিমল মণ্ডলকে। পরাগের মা লিপি মণ্ডল জানান, বিমল কারখানায় গেছেন। ১১ দিন পর গতকাল কারখানা আবার চালু হলো।
আমির-জুয়েলকে গ্রেপ্তারে রুল : পরাগ অপহরণ ঘটনায় যুবলীগ নেতা জুয়েল ও আমির হোসেনকে গ্রেপ্তারের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে গতকালই রুল জারি করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি ফরিদ আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার এ রুল জারি করেন। স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ঢাকা জেলা প্রশাসক (ডিসি), র‌্যাবের মহাপরিচালক, ডিআইজি (ঢাকা রেঞ্জ), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার, র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার এবং কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এক সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া এ বিষয়ে আগামী ২৯ নভেম্বর শুনানির জন্য পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে।
নাজিম আহাম্মেদ নামের এক সাংবাদিকের করা রিট আবেদনের সঙ্গে সম্পূরক আবেদন হিসেবে বুধবার সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনা চেয়ে এ আবেদন করা হয়।
গত ১৫ নভেম্বর পরাগ মণ্ডলসহ তার পরিবারকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতের নির্দেশ দেন হাইকোর্টের একই বেঞ্চ। একই সঙ্গে তাদের পরিবারকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়েও রুল জারি করে আদালত। আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ড. মো. ইউনূস আলী আকন্দ। সরকার পক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার।

No comments

Powered by Blogger.