সুযোগে গুজব ছড়ানো ঠিক নয় by আবদুল মান্নান

নবম জাতীয় সংসদের সদস্যদের ৯৭ শতাংশ নেতিবাচক কাজে জড়িত আছেন বলে টিআইবি যে জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে নিঃসন্দেহে যথেষ্ট ফাঁক রয়েছে। এ জন্য টিআইবির রিপোর্টটি প্রশ্নাতীত নয়, বরং বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। যার রেশ ধরে সংসদেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
তা হবেই, কারণ বাংলাদেশের সরকার বা সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে টিআইবির এটি একটি সার্ভে বা গবেষণা রিপোর্ট। গণতান্ত্রিক দেশে যেকোনো সৎ ও যোগ্য প্রতিষ্ঠানের অধিকার রয়েছে এ ধরনের গবেষণা করার, যা অবশ্যই জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানের জরিপ পদ্ধতিতেই যদি ত্রুটি থেকে যায়, তার ফলাফল ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না। মূলত আমাদের বক্তব্যের বিষয়টি তা-ই।
টিআইবির মতো প্রতিষ্ঠান যেকোনো দেশে কাজ করলে সে দেশের মঙ্গলই হবে বলে আমি মনে করি। তবে আমাদের দেশে টিআই-র যে স্থানীয় শাখা রয়েছে এবং এর দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা সবাই নিঃসন্দেহে সমাজের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। কথা হলো, কোনো সরকার বা সংসদ সদস্যদের নিয়ে এ ধরনের জরিপ পরিচালনা করতে আরো সতর্ক ও নির্ভুল পদ্ধতি অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। কেননা সংসদ সদস্যরা শুধু ব্যক্তি নন। একজন সংসদ সদস্য জনগণের ইচ্ছা ও পছন্দকে ধারণ করেন। এই সংসদ ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট দেশের মর্যাদা জড়িত থাকে তাঁদের সঙ্গে। তাই টিআইবি তাদের জরিপ ফল প্রকাশের আগে আরো ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারত। অথবা সতর্ক হলে জরিপ শুরু করার আগেই নির্ভুল পদ্ধতি বেছে নিতে পারত।
তারা যে ১৪৯ জন সংসদ সদস্যের ওপর জরিপ করেছে, তাঁরা কোন এলাকার বা কোন কোন এলাকার এমপি-মন্ত্রীদের ওপর জরিপ চালালে ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের ভাবমূর্তি উপস্থাপন করা সম্ভব- এ বিষয়টি কিভাবে নির্বাচন করল? কারণ যে ১৪৯ জনের ওপর তারা গবেষণা করেছে তাঁদের ৯৭ শতাংশই যদি নেতিবাচক কাজে জড়িত থাকেন, তাহলে কি ৩৫০ জন সদস্যের অর্থাৎ পুরো সংসদের ৯৭ শতাংশ বলে প্রমাণিত হয়? এখানে জরিপের পদ্ধতি ও শতকরা হিসাব প্রকাশে ফাঁক রয়েছে; যা শুধু বিভ্রান্তিই ছড়াবে।
টিআইবির সহযোগী সংগঠন রয়েছে যেসব এলাকায়, সেখানে তারা এই জরিপ করেছে সেই সংগঠনের মাধ্যমে। স্থানীয় সংগঠন বা শাখা অফিসে কেন্দ্রীয় অফিসের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। তাই কেন্দ্রীয় অফিস অর্থাৎ টিআইবির উদ্দেশ্যই প্রতিফলিত হয়েছে। স্থানীয় যেসব লোকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে তাদের সংখ্যা ৬০০ জন। আমাদের প্রশ্ন হলো, ওই ৬০০ লোক কী করে আট কোটি ভোটারের পছন্দ বা তাদের ভাষ্য বহন করবে? তা ছাড়া এ ৬০০ জনের মধ্যে নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বেকার-চাকরিজীবী ও ধর্ম-বর্ণের যে পার্থক্য রয়েছে, সেগুলোর সরলীকরণ কিভাবে করেছে টিআইবি? সারা দেশের বা ৩৫০ জন সদস্যের খবর জানা হলো কিভাবে এই পদ্ধতিতে?
টিআইবির মতো প্রতিষ্ঠান ১৪৯ জনের ওপর জরিপ না চালিয়ে ৩৫০ জনের ওপরই তাদের মূল্যবান গবেষণাটি করতে পারত। আর এ কাজে তাদের সংস্থার লোক না রেখে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের দিয়ে তা পরিচালিত হতে পারত। টিআইবির দ্বারা তা অসম্ভব হতো না। যেকোনো কিছু খণ্ডিতভাবে দেখা ও খণ্ডাংশের ওপর নির্ভর করে সম্পূর্ণ কোনো কিছুর বিচার করা যৌক্তিকতা বা নৈতিকতা- কোনো কিছুতেই সমর্থিত হতে পারে না।
গণতন্ত্রের সুযোগে আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে মর্যাদাধারী টিআইবির মতো প্রতিষ্ঠান যদি এমন বিভ্রান্তি ছড়ায় একের পর এক, এতে অবশ্যই জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হবে এবং সুযোগসন্ধানী বিভিন্ন দল-গোষ্ঠী সুযোগ গ্রহণ করবে। তাতে করে দেশের মঙ্গল না হয়ে অশান্তি-অরাজকতা বাড়বে। তাই আমরা আশা করব, টিআইবি কাজ করবে, কিন্তু দেশের মানুষের প্রতি গণতান্ত্রিক দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে। গণতন্ত্রের অর্থ সুযোগে গুজব ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীলতার পথে নিয়ে যাওয়া নয়।
অনুলিখন ও গ্রন্থনা : লুৎফর রহমান রনো

No comments

Powered by Blogger.