বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৭৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।  মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম
দুঃসাহসী ও অতুলনীয় এক মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ১৯৭১ সালে ইপিআর বাহিনীর চট্টগ্রাম সেক্টরের অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা (ক্যাপ্টেন) ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন লাভ করেন। পরে আর্টিলারি ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে তাঁর ইউনিট পাকিস্তানের (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) লাহোর থেকে যশোর সেনানিবাসে বদলি হয়। এর কিছুদিন পর তিনি প্রেষণে ইপিআর বাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে দিনাজপুর সেক্টরে উপ-অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রাম সেক্টরে যোগ দেন।
১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই সম্ভাব্য যুদ্ধের আশঙ্কায় রফিকুল ইসলাম মানসিকভাবে প্রস্তুত হন। সেক্টর সদর দপ্তরে অবস্থানরত বেশির ভাগ বাঙালি সদস্যদের গোপনে উদ্বুদ্ধ করেন। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ কার্যক্রম শুরু করার আগেই তিনি বিদ্রোহ করে বাঙালি ইপিআর সেনাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে রফিকুল ইসলামের অবদান অসামান্য। তাঁর নেতৃত্ব ও পরিচালনায় বাঙালি ইপিআর সেনারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
এখন জানা যাক রফিকুল ইসলামের নিজ বয়ানে কিছু কথা: ‘২৫ মার্চ ১৯৭১, বৃহস্পতিবার। অন্যান্য দিনের মতো সকাল সাতটায় অফিসে গেলাম। সেখানে পৌঁছেই দেখি পাকিস্তানি মেজর ইকবাল বসে আছেন।...সেদিন বেলা দুইটায় ইপিআর সদর দপ্তর ত্যাগ না করা পর্যন্ত মেজর ইকবাল আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করল।
‘ইয়াহিয়ার সঙ্গে মীমাংসায় পৌঁছা গেছে বলে এ সময়ে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তবে নির্ভরযোগ্য কোনো মহল থেকে এর সত্যতা পাওয়া গেল না। বাসা থেকে সদর দপ্তরে ফোন করে সব সৈন্যকে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিলাম। তারপর অস্থিরভাবে বাড়ির লনে পায়চারি করতে লাগলাম।
‘চারটা ৩০ মিনিটের দিকে ডা. জাফর আমার বাসায় এলেন।...রাত আটটার দিকে তিনি ঢাকার কোনো সংবাদ এসেছে কি না জানার জন্য আওয়ামী লীগ অফিসে গেলেন। (রাতের খাবার) খাওয়া শুরু করেছি, এমন সময় একজন আওয়ামী লীগ কর্মীসহ তিনি ফিরে এলেন। রাত তখন আটটা ৩০ মিনিট। (ডা. জাফর বলেন) “মনে হচ্ছে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গোপনে করাচি গেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।”...আমি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম।
‘সেনাবাহিনী ট্যাংক নিয়ে বেরিয়ে থাকলে নিশ্চয় ভয়ানক কিছু ঘটাবে। ৩ মার্চ থেকেই ওরা বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করছে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম ইপিআরের দুটি ওয়্যারলেস সেটই ঢাকার পিলখানার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিল না। এমন কোনো দিন ঘটেনি। সন্দেহ গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠল।
‘এ সময় নিজের ভেতর থেকে আমি যেন এক অলৌকিক সাহস অনুভব করলাম। মনে হলো, আমার ভেতর থেকে কে যেন আমাকে বলছে নিজের জীবন ও অন্যদের জীবন রক্ষার জন্য পশুশক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।...“হয় স্বাধীনতা অর্জন, না হয় ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু”—এ ধরনের এক চরম সিদ্ধান্ত নিলাম। ডা. জাফরকে বললাম, আমাদের জনগণকে মুক্ত করার জন্য আমি আমার বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করব।
‘রাত আটটা ৪৫ মিনিট। আমি শেষবারের মতো আমার সারসন রোডের বাসভবন ত্যাগ করলাম। ওয়্যারলেস কলোনির দিকে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল।...ক্যাপ্টেন হায়াতের রুমের সামনে জিপ থামালাম। সাবধানে তার কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলাম। খুব আস্তে দরজা নক করলাম। বন্ধুসুলভ গলায় বললাম, “হ্যালো, হায়াত ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি?” আমার গলার স্বর চিনতে পেরে সে আলো জ্বালাল। আমি দরজা খোলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।...আমি স্টেনগান তাঁর বুকে ধরে বললাম, “আমি দুঃখিত হায়াত, তোমাকে গ্রেপ্তার করতে হচ্ছে।” সে তার পিস্তল বের করতে ধরলে ড্রাইভার কালাম (বাঙালি) দ্রুত এগিয়ে আসে। অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে প্রথম কাজ সমাধা হলো।’
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১১।
মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই মেজর পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে তিনি ঢাকা ওয়াসা, হ্যান্ডলুম বোর্ড ও বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (১৯৯০) উপদেষ্টা এবং ১৯৯৬-২০০১ সালে সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি চাঁদপুর ৫ আসনের সাংসদ।
মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার নাওড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আশরাফউল্লাহ, মা রহিমা বেগম। স্ত্রী রুবি ইসলাম। তাঁদের এক মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.