বিলেতের স্ন্যাপশট- বিলেতে বাংলা ভাষা by শামীম আজাদ

এখানে মাধ্যমিক স্কুলে ওঠার পর ছেলেমেয়েদের বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে একটি দ্বিতীয় ভাষা শেখার চল অনেক দিনের। যে স্কুলে যে ভাষার চাহিদা থাকে, সে হিসেবেই শিক্ষাদান করতে হয়। তবে এই দ্বিতীয় ভাষার ব্যাপারে ইউরোপিয়ান ভাষা নিয়েই সবার প্রবল আগ্রহ।
ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান, পর্তুগিজ, ইতালিয়ান—এসব। এমনকি এসব ভাষা শিক্ষাকালে তা চর্চার অজুহাতে স্কুলই চট করে ফ্রান্স, জার্মানি বা ইতালি ঘুরিয়ে আনে। তখন নোটবই দেখে দেখে প্যারিসে পথের অ্যাভাকাডো ফলের দরদাম করা, ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়ামের সামনে গিয়ে জলস্থাপত্যের পাশে দাঁড়িয়ে কষ্টেসৃষ্টে পোস্টার পড়া অথবা বার্লিনে বরফভালুকের নিচে কোনো এক উল্ফগাংয়ের নামটি বানান করা—অতটুকুই! এতে কি আর ভাষা রপ্ত হয়? ভাষা শিখতে হলে চর্চার জন্য পথে পথে সাইনবোর্ড দেখা চাই, টিভি সিরিয়ালে আঠা হওয়া চাই। সে ভাষায় কেনাকাটা, গান গাওয়া, আবৃত্তি করা, বক্তৃতা দেওয়া, উপস্থাপনা করা—সবই চাই। কারণ, চর্চায় এর বৃদ্ধি আর বিনা চর্চায় মৃত্যু। আমার সহকর্মীদের অনেকেই ছোটবেলায় স্কুলে বাধ্যতামূলক একটি দ্বিতীয় ভাষা শিখলেও, ব্যতিক্রম ছাড়া কেউই ইংরেজি ছাড়া আর কোনো ভাষা বলতে পারে না। কিন্তু এদের এই দ্বিতীয় ভাষাটিই বাড়িয়েচুড়িয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। পূর্ণ বয়স্কদের বিদেশি ভাষা শেখার ব্যবস্থা পথে পথে।
যেসব ভাষা আগামী দিনের বিজনেস কমিউনিটির ভাষা হবে, ভবিষ্যৎ ভাষার বিকল্প হয়ে যাবে, সেসব ভাষা নিয়ে এদের এমন সব প্রকল্প। প্রজন্মকে তৈরি করতে বিলেতে তাই এমন ব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু বদলে যাওয়া বৈশ্বিক অর্থনীতির হাওয়ার বাণিজ্য বেসাত ইউরোজোনের হাত থেকে পিছলে পড়েছে। কিন্তু বেনিয়া ব্রিটিশ জাতের অসুবিধে নেই। নিয়েছে নতুন কৌশল। এ কারণেই একদিন এরা হিন্দি-উর্দুও শিখেছিল। আর সেভাবেই, আগামী বিশ্বের ক্ষমতাবানদের কথা ভেবেই ম্যান্ডারিন, ক্যান্টোনিজ, জাপানি ও আরবি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছে তারা। এখন কথা হলো দুটো: এক. ভবিষ্যতে যে যে দেশে গিয়ে কাজ করা যাবে, সে কথা ভেবে বিষয় নির্বাচন করা। দুই. ছাত্রছাত্রীদের পছন্দানুযায়ী বিষয় পছন্দ করা এবং শিক্ষক সরবরাহ করা।
আর এরই সুযোগে এসে গিয়েছিল বাংলা ভাষা শেখানোর ব্যাপারটিও। আর আন্দোলনে অভিজ্ঞ বাঙালিরা তেমন দাবিতেই প্রায় আড়াই দশক আগে জিসিএসইতে এবং তারপরে এ-লেভেলে বাংলা চালু করে ফেলে। একটি অভিবাসী সমাজের জন্য তা ছিল এক যুগান্তকারী অর্জন। আমাদের ছেলেমেয়েরা এ-লেভেলের তিনটি বিষয়ের একটি বিষয় হিসেবে বাংলা করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুড়দাড় করে ঢুকে গেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, পড়ানোর জন্য বাংলা শিক্ষকের অভাব ছিল না। প্রথম দিকে পেশাদার ও কোয়ালিফায়েড শিক্ষকদের সাহায্যেই তা চলছিল, এখন তাঁরা ছাড়াও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণ শিক্ষকেরাও আছেন।
এবার এসেছে আরেকটি সুযোগ। এটা হলো সম্প্রতি লর্ড ডেয়ারিংয়ের এক শিক্ষা রিপোর্ট। সেখানে মাধ্যমিক নয়, প্রাথমিক স্কুলে মূল ক্লাসেই ছেলেমেয়েদের দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ। যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই আমাদের আগামী প্রজন্মকে নিজ মাতৃভাষা সম্পর্কে একটু হলেও ধারণা দেওয়া যায়, তাহলে মাধ্যমিকে তারা এ ভাষাই নেবে। আর তারপর বাংলায় এ-লেভেল করতে পারলে এ জীবনে আর তাদের শিকড় ও ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত করার সুযোগ থাকবে না। ভাষা বাঁচলে তবে সংস্কৃতি বাঁচে, সংস্কৃতি বাঁচলে তবে বাংলার ঐতিহ্য বাঁচে।
যেকোনো দেশের রাজধানীর মতোই লন্ডন শহরও বহিরাগত, ছিন্নমূল, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের শহর। সম্ভবত লন্ডন শহরে ১৩১টি স্পোকেন ল্যাঙ্গুয়েজ আছে। আর বাংলার স্থান তার একেবারে প্রথম দিকে। বিলেতে প্রায় চার লাখ বাঙালির বসবাস। কেবল বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকা টাওয়ার হ্যামলেটস—বাংলা টাউনেই বসবাস করেন প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি। সুতরাং সরকার যখন উচ্চারণ করলেন যে স্থানীয় চাহিদানুযায়ী শিশুদের দ্বিতীয় ভাষা পছন্দ করার অধিকার থাকবে, তখন তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে একটা শুভংকরের ফাঁকি ঢুকে গেল। যে স্কুলে প্রায় নব্বই শতাংশ শিশুই বাঙালি, সেখানেও স্কুল প্রশাসন বাবা-মাকে বোঝালেন, অন্য ইউরোপিয়ান ভাষার যেকোনোটি শিখলে সে ভবিষ্যতে সেসব দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে ইত্যাদি। কোনো কোনো স্থানে বাংলা ভাষার ক্যাম্পেইনারদের প্রচারপত্র বিলি, স্বাক্ষরাভিযান পরিচালনাতেও বাধা এল। আকারে-ইঙ্গিতে তাদের নিরত করা হচ্ছে। ফলে দুটো মূল ধারার স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও বাংলা ভাষাকে ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষার সমান মর্যাদায় পড়ানো সম্ভব হয়নি।
কিন্তু সবাই জানেন, এখানে এই তৃতীয় বাংলায় বাংলা শিখলে তার চর্চার এন্তার সুযোগ রয়েছে। চ্যানেল এস, বাংলা টিভি, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, এনটিভি ও চ্যানেল নাইন মিলে আধা ডজন বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল। সারা ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে চার-পাঁচটি স্থায়ী শহীদ মিনার। আধা ডজন বাংলা কাগজে সাহিত্য বিভাগ, শিল্প বিভাগ, বাঙালির সাফল্য সংবাদ নিত্য ছাপা হচ্ছে। প্রতিদিনই জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন অনলাইন বাংলা সংবাদপত্র আর ব্লগ। চার দশকের পরিপোক্ত এ বাঙালি সমাজ আমাদের দিয়েছে বাঙালি নাপিত, ধোপা, ট্যাক্সিচালক, মুদি দোকানি, হাসপাতালের নার্স থেকে শুরু করে পেরি পেরি ফ্রাইড চিকেন বিক্রেতাও। এখন এমন অবস্থা যে, যেকোনো বাঙালি বিলেতে এসে পড়াশোনা করে খেয়েদেয়ে ডিগ্রি নিয়ে ফেরত চলে যেতে পারেন শুধু বাংলা ব্যবহার করেই।
তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুর ভাষা পছন্দ করানোর দায়িত্ব মা-বাবার। তাঁরা যদি এ সুযোগ নেন, তাহলে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও তাঁদের সন্তানদের জন্য খুলে যাবে বাংলাদেশের দরজা। বাংলা শিখে বড় হলে, একদিন যখন তারা পেশাজীবী হবে, বিশেষজ্ঞ হবে তখন সহজেই কথাবার্তা বলতে পারছে বলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ, ব্যবসা ও চাকরির দিগন্ত খুলে যাবে। দিগন্ত খুলে যাবে প্রবাসে থাকা সব বাঙালির জন্য। এদের সংখ্যা অর্ধকোটিরও বেশি।
এমন সুযোগ আর একবার আসবে বলে মনে হয় না। আর এ সুযোগ না নিলে যে কষ্ট করে আমাদের পূর্বসূরিরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে বাংলা এনেছিলেন, তাও টিকিয়ে রাখা যাবে না।
শামীম আজাদ: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
shetuli@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.