সমালোচনাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা উচিত- টিআইবি ও জাতীয় সংসদ

সাংসদদের সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন সংসদ ও সরকারকে অসন্তুষ্ট করেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই অসন্তোষের মাত্রা এত বেশি যে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান ও মর্যাদাসম্পন্ন এই সংস্থার নির্বাহী পরিচালকসহ অন্যদের সংসদের বিশেষ কমিটিতে তলব করা, এমনকি সংস্থাটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি পর্যন্ত উচ্চারিত হয়েছে।
বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে স্বাধীনভাবে কাজ করে, এমন যেকোনো নাগরিক-সামাজিক সংস্থার কাজে নির্বাহী ও সংসদীয় ক্ষমতাধরদের এ ধরনের প্রতিক্রিয়া সুশাসন, জবাবদিহি, নৈতিকতা এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের হুমকি, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সাংসদদের সম্পর্কে সমাজে সাধারণভাবে যেসব নেতিবাচক ধারণা চালু রয়েছে বলে টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো বহুল আলোচিত। যেমন: নিজ নিজ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক কাজে প্রভাব বিস্তার, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বরাদ্দ অর্থের অপব্যবহার, সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার, নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট-ফ্ল্যাট বরাদ্দ নেওয়া ইত্যাদি। সাংসদেরা যতই ক্ষুব্ধ বা রুষ্ট হোন না কেন, এসব ক্ষেত্রে তাঁদের সম্পর্কে জনগণের সাধারণ ধারণারই প্রতিফলন ঘটেছে টিআইবির প্রতিবেদনে। ৯৭ শতাংশ সাংসদের অনৈতিক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেছে টিআইবির একটি জরিপের ভিত্তিতে; সামাজিক সমীক্ষা-জরিপের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতভাবেই তা করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আপত্তির একটি বিষয় এ রকম যে এতে সাংসদদের অনৈতিকতার সঙ্গে জড়িত করা হয়েছে পাইকারি হারে। ‘৯৭ শতাংশ’ই আপত্তিকারীদের বিচলিত ও রুষ্ট করেছে বলে মনে হয়।
লক্ষ করার বিষয়, টিআইবির প্রতিবেদনটি সমীক্ষা-জরিপে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রচিত। এর বিরুদ্ধে সাংসদদের প্রবল আপত্তির ভিত্তি কিন্তু অন্য কোনো জরিপভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত নয়, বরং নিজেদের সম্পর্কে তাঁদের নিজেদেরই ধারণা বা মানসিকতা। তাঁরা মনে করেন যে তাঁদের নৈতিকতার মান উচ্চ। তাঁদের সম্পর্কে জনগণের প্রকৃত ধারণা কী, আর তাঁদের মধ্যে কতজন নিজের বিবেকের কাছে কতটা সৎ—এটা তাঁরা নিজেরাই ভেবে দেখতে পারেন। জাতীয় সংসদ নিজেই এ রকম একটা সমীক্ষা-জরিপ চালিয়ে দেখতে পারে; টিআইবির পাল্টা জবাব দিতে বা জনগণের সামনে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার প্রচারণার লক্ষ্যে নয়, বরং আন্তরিকভাবে প্রকৃত অবস্থা পরিমাপের উদ্দেশ্যে।
সৎ ও প্রকৃত জনকল্যাণকামী সাংসদ একজনও নেই, টিআইবির প্রতিবেদনে এমন কথা বলা হয়নি। যাঁরা সে রকম আছেন, তাঁদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য এবং সেটাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। টিআইবির প্রতিবেদনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইত্যাদি বলে সম্পূর্ণভাবে নাকচ করা বা সংস্থাটির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার ভাবনা পরিহার করা উচিত। কারণ, তাতে সাংসদদের নৈতিকতার মান উন্নত হবে না, বরং উল্টোটি ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। সাংসদেরা নিজেদের ট্রেড ইউনিয়ন বা পেশাজীবী কোনো গোষ্ঠীর মতো করে সীমাবদ্ধ দৃষ্টিতে না দেখে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখলে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটবে, দেশের মঙ্গল হবে।

No comments

Powered by Blogger.