১১০ বছর পর!-অভিষেকে ১০ নম্বরে আবুল হাসানের সেঞ্চুরি byমাসুদ পারভেজ

ফিডেল এডওয়ার্ডসের ঠুকে দেওয়া অর্থাৎ লাফিয়ে ওঠা বলে সেঞ্চুরির ঠিক আগেই বাঁ হাতের তর্জনীতে সামান্য চোট পেয়েছেন। সেটার শুশ্রূষাও দরকার। আবার ১১০ বছর পর কোনো দলের ১০ নম্বর ব্যাটসম্যানের টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরির কীর্তির জন্ম দেওয়ার পর সংবাদমাধ্যমও তাঁর জন্য ব্যাকুল প্রতীক্ষায়।
তাই গ্লাসভর্তি বরফশীতল পানিতে আঙুল ডুবিয়েই সংবাদ সম্মেলনে চলে এলেন আবুল হাসান রাজু। শুরুর আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমাম এটাও সবাইকে জানাতে ভুললেন না যে 'টেস্টের মতো সংবাদ সম্মেলনেও কিন্তু আজই অভিষেক হচ্ছে ওর।'
কক্ষভর্তি লোকের সামনে কথা বলার প্রথম অভিজ্ঞতায় তাই কিছুটা জড়তা থাকল। মাঝে নিজেও একবার বললেন যে 'এত মানুষের সামনে আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না।' ছোট ছোট কথায় প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছিলেন যদিও, কিন্তু তাতে সংবাদমাধ্যমের জন্য এমন বিশেষ কিছুর সন্ধান মিলছিল না। একপর্যায়ে তাই একজন এমনও বলে ফেললেন যে 'সেঞ্চুরির অনুভূতিটা একটু ব্যক্ত করুন। আবোলতাবোল হলেও কিছু একটা বলুন।' এডওয়ার্ডস, সুনীল নারিনদের ঠেঙিয়ে সেঞ্চুরি করে আসা হাসান এমনই জড়সড়। সংবাদ সম্মেলনটা শেষ হতেই আরেক কাণ্ড। বিসিবি থেকে সংবাদমাধ্যমকে সরবরাহ করা স্কোরকার্ডের ওপর অনেকেই তাঁর অটোগ্রাফ নিয়ে রাখছিলেন। কেউ কেউ তুলছিলেন তাঁর সঙ্গে ছবিও। এমন কিছুর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের পর মিডিয়া ম্যানেজারকে তাঁর কৌতূহলী জিজ্ঞাসা, 'সেঞ্চুরি করলে কি এমনই হয় নাকি?'
দলের শীর্ষ ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা কিছুটা হলেও আড়াল করতে পারা সেঞ্চুরিতে হাসানের চারপাশটা এমনই বদলে গেছে। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে মাঠ পেরিয়ে ড্রেসিংরুমে ফেরার সময় স্থানীয় একজন এসে তাঁকে এই খবরও দিয়ে গেলেন যে 'ওই যে শুনুন, বাইরে আপনার নামে আনন্দ মিছিল বের হয়েছে।' মিছিলের আনন্দধ্বনি তখন শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম এলাকা কাঁপিয়েও তুলেছে। অবশ্য জানতেন না যে টেস্ট ইতিহাসে ১০ নম্বর ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ডটাও তাঁর হাত বাড়ানো দূরত্বে। আর ১৮ রান করলেই হয়, 'ড্রেসিংরুমে তো আমাকে কেউ বলেনি।' সংবাদ সম্মেলনে জানার পর শুধু বললেন, 'এটা আসলে আমার কাছে মূল বিষয় না। যতক্ষণ খেলতে পারি, রিয়াদ (মাহমুদ উল্লাহ) ভাইকে সাপোর্ট করব। আর উইকেটে থাকতে পারলে রেকর্ডটাও হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।'
বারবার জানতে চাওয়ার পরও সেঞ্চুরির অনুভূতি এক কথায়ই প্রকাশ করলেন বেশি, 'হান্ড্রেড করলে একজন ব্যাটসম্যানের যেমন লাগে, আমারও তেমনই লাগছে।' আর এ সেঞ্চুরিতে দেশের সপ্তম টেস্ট ভেন্যু হিসেবে আত্মপ্রকাশের দিনে খুলনার উৎসবের রংটা ঘোলা হয়ে যায়নি। যে সেঞ্চুরিতে মোহিত হয়ে এমনকি ক্রিস গেইলও অভিনন্দন জানিয়ে গেছেন তাঁকে, 'গেইল উৎসাহ দিলেন খুব। এটাও বলেছেন যে আমি ভালো ব্যাটিং করেছি। এরপর আমার ব্যাটের নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, ইংলিশ ব্যাট।' ব্যাটটা ইংল্যান্ড থেকে আনা বলেই এমন নাম। ওই ব্যাট দিয়ে তাঁর ব্যাটিংয়ের রিপ্লে দেখার সময় ড্রেসিংরুমে নাকি অনেকে এও বলাবলি করেছেন, 'রিপ্লে দেখে তো মনে হচ্ছে, তামিমই ব্যাট করছে।' দল-সংশ্লিষ্ট একজন এমনই জানিয়ে গেলেন।
অবশ্য তাঁর এ ব্যাট এবং ব্যাটিংয়ের সঙ্গে তামিমের একটা যোগসূত্র ঠিকই আছে। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে ফেরার সময় বলছিলেন, 'তামিম ভাইয়ের ব্যাট এটা। উনি আমাকে দিয়েছিলেন।' তখন উপস্থিত সাংবাদিকরা তথ্যটা নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠতেই আবার সঙ্গে সঙ্গে সংশোধনীও দিলেন, 'আসলে ব্যাটটা আমি তামিম ভাইকে দিয়ে ইংল্যান্ড থেকে আনিয়েছি।' সেই ব্যাটে সেঞ্চুরি করা হাসানের এর আগে কোনো পর্যায়েই কোনো সেঞ্চুরি নেই। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে কেবল একটা ফিফটি আছে; যদিও জানিয়ে রাখলেন, 'বাংলাদেশের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেটে কিন্তু আমি ব্যাটসম্যানই ছিলাম। ওই সময়ই একটা ম্যাচে ভালো বোলিং করেছিলাম। তখন নান্নু স্যার ও নোবেল স্যার বললেন, তুই পেস বোলিং কর। ব্যস, হয়ে গেলাম পেস বোলার।'
ডানহাতি এ পেসার ব্যাটিংয়ে তামিমের মতোই বাঁ হাতি। কিন্তু ব্যাটসম্যান না হয়েও তাঁর ওরকম ব্যাটিংয়ের রহস্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন, 'আসলে তেমন কিছু না। যখন ব্যাটিংয়ে গিয়েছি, নিজেকে ব্যাটসম্যান মনে করেই গিয়েছি। ব্যাটসম্যানের মতোই খেলার চেষ্টা করেছি।' হার না মানা ১০০ রানের ইনিংসটা রেকর্ডের হাতছানি দিয়ে রাখছে তাঁকে। তবে গত পরশু রাতে অভিষেকের খবরটা পাওয়ার পর যে লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন, এখনো তাতেই অবিচল আছেন হাসান, 'আমার মূল লক্ষ্য হলো বোলিং। বোলিংটা ভালো করতে পারলেই আমি খুশি।' আর আজ প্রথম সেশনের লক্ষ্যটাও খুব সাধারণ, 'রিয়াদ ভাইকে (মাহমুদ উল্লাহ) যতটা সম্ভব সাপোর্ট করার লক্ষ্য নিয়েই নেমেছিলাম। কাল সকালেও লক্ষ্যটা তা-ই থাকবে।' সেঞ্চুরির কথা তাঁর মাথায় প্রথম আসে, 'আমার যখন ৭০ পার হয়ে গেছে, তখন থেকেই মনে হচ্ছিল ইনশা আল্লাহ কিছু একটা করব।' করে ফেলার পর দেখা গেল হাত থেকে ব্যাটটা পড়ে গেল। মনের ভেতর দিয়ে কোন আনন্দের রেলগাড়ি চলছিল তখন? হাসান কিছুই বলতে পারলেন না, 'আমার কিচ্ছু মনে নেই।'
তবে ২০০৮ সালে অন্যলোকে পাড়ি জমানো বাবা আবদুল খালেকের কথা ভাবতেই আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন খুব, 'আমার এত দূর উঠে আসার পেছনে প্রথমত অবদান আমার আব্বুর। ওনার অনেক ইচ্ছা ছিল আমাকে এ পর্যায়ে খেলতে দেখার। কিন্তু আজ আব্বু নেই।' যাঁরা আছেন, তাঁদের কথাও বলতে ভুললেন না মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থেকে উঠে আসা এ তরুণ, 'জেলা কোচ রাসেল ভাই ও সিলেট বিভাগীয় কোচ ইমন ভাইরা অনেক কিছু করেছেন আমার জন্য। আর আমাকে ঢাকার প্রিমিয়ার লিগে নিয়ে এসেছেন সুজন ভাই (খালেদ মাহমুদ)। বাংলাদেশ দলের সাবেক এ অধিনায়ক হাসানের ক্রিকেট অভিভাবকও। সে জন্যই খেলা শেষে কাল সন্ধ্যায় মমতাময়ী মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর প্রথম ফোনটা যাঁকে দিয়েছেন, তিনি ওই মাহমুদ,
যিনি বড় পর্যায়ে আসার পথ দেখিয়েছিলেন। সেই পথ ধরে এগোতে এগোতে কাল দুই ক্ষেত্রেই অভিষেক হলো হাসানের। টেস্ট খেলার যেমন, তেমনি সংবাদ সম্মেলনে হাজিরা দেওয়ারও!
এক দিনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান

No comments

Powered by Blogger.