লাইবেরিয়া-সামাজিক উন্নয়ন কাজে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী by মোঃ লুৎফর রহমান

উন্নত শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের কারণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ দেশে-বিদেশে সমানভাবে প্রশংসিত। আদর্শ চরিত্র গঠনের জন্য সেনাবাহিনীতে চরিত্র গঠনমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে প্রত্যেকটি সেনাসদস্যকে আইন-শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য শিক্ষা দেওয়া হয়।
এরূপ আদর্শিক শিক্ষায় শিক্ষিত আমাদের শান্তিরক্ষীরা লাইবেরিয়ার সমাজ হতে ধর্ষণের মতো অনৈতিক ও ঘৃণিত এ কর্মকাণ্ডকে চিরতরে উৎখাত করতে যে মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেন তা টঘগওখ, বিভিন্ন এনজিও, লাইবেরিয়ার সরকার তথা লাইবেরিয়ার আপামর জনসাধারণের কাছ থেকে ভূয়সী
প্রশংসা অর্জন করে


পরিদর্শনের অংশ হিসেবে আজ আমাদের টহরঃবফ ঘধঃরড়হং গরংংরড়হ রহ খরনবৎরধ (টঘগওখ)-এর বাংলাদেশ মেডিকেল কন্টিনজেন্ট, ব্যানমেড-৭-এ নিয়ে যাওয়া হয়। উল্লেখ্য, ব্যানমেড কন্টিনজেন্টটি ২০০৪ সালে লাইবেরিয়ায় নিয়োজিত প্রথম জাতিসংঘ কন্টিনজেন্টগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ কন্টিনজেন্টটি শান্তিরক্ষীদেষ জন্য এখানে একটি 'লেভেল-২' হাসপাতাল নামে পরিপূর্ণ হাসপাতাল পরিচালনা করছে। বিষয়টি দেখে আমার কৌতূহল জন্মে, তাই আমি এ নিয়ে লিখতে আগ্রহী হয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নিলাম এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ লেখাটির অবতারণা করলাম।
আফ্রিকার যে কয়টি গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ রয়েছে তার প্রতিটিতে যে সমস্যাটি অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করে আছে তা হলো ধর্ষণ। সেখানে এটি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। লাইবেরিয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি ভীতিকর পরিস্থিতিই বলতে হয়। এক রিপোর্টে জানা যায়, প্রতি সপ্তাহে গড়ে অন্তত ৭টি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে দেশটিতে (যে দেশের জনসংখ্যাই মাত্র ৪০ লাখের মতো)। আর হিসাবের বাইরের চিত্র আরও ভয়াবহ। কারণ প্রত্যন্ত অনেক অঞ্চল রয়েছে যার সংবাদ পত্রিকা বা সমীক্ষাকারীদের কাছে আদৌ পেঁৗছায় না বা অনেকে লজ্জা বা ভয়ে সত্যটি স্বীকারও করে না। আরেকটি বিষয় হলো, যেসব মেয়ে এই ঘৃণ্য অপরাধের শিকার তাদের অধিকাংশই অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী, যারা পরে নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত জটিলতা ও মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভোগে। গত বছর মে মাসে ঝবীঁধষ ঠরড়ষবহপব রহ ঈড়হভষরপঃ বিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি গধৎমড়ঃ ডধষষংঃৎড়স লাইবেরিয়া পরিদর্শন করেন। তার এ পরিদর্শনের সময়ই টঘগওখ সেক্টর-বি (ব্যানসেক্টর-৭)-এর কমান্ডার এ বিষয়ে কার্যকর অবদান রাখতে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বিষয়টি ব্যানমেড-৭কে অবহিত করেন এবং এ ব্যাপারে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেন। ব্যানমেড-৭-এর অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ ডাক্তাররা ধর্ষণের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমাজ থেকে ধর্ষণকে সমূলে উৎপাটনের লক্ষ্যে 'চৎবাবহঃরড়হ ধহফ জবংঢ়ড়হংব ঃড় ঝবীঁধষ ধহফ এবহফবৎ ইধংবফ ঠরড়ষধহপব' শীর্ষক দুই সপ্তাহব্যাপী এক প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করেন। প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয় :ক. স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে ধর্ষণের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা। খ. এ বিষয়ে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের সৃষ্টি করা। গ. ধর্ষণ প্রতিরোধে স্থানীয় জনসাধারণকে প্রেষণা দান করা। ঘ. ধর্ষণের ফলে মানসিক ভারসাম্যহীনতা ও সমাজের ওপর এর প্রভাব বিষয়ক প্রচারণা।
বাংলাদেশ স্কয়ারে (বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট কর্তৃক স্থাপিত বাঙ্গা শহরের উপকণ্ঠে স্থাপিত খেলার মাঠ, পার্ক, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি সংবলিত সুপরিসর স্থান) অবস্থিত ইধহমষধফবংয খরনবৎরধ ণড়ঁঃয ঈবহঃৎব (ইখণঈ)-এ প্রশিক্ষণ কোর্সটি পরিচালিত হয়, যাতে লাইবেরিয়ার ১০টি জেলা থেকে ২২ জন যুবক-যুবতী অংশগ্রহণ করে। এ ফোর্সের অধিকাংশ ক্লাসই ব্যানমেড-৭-এর ডাক্তার কর্তৃক পরিচালিত হয়। তাছাড়া স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, টঘগওখ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, লাইবেরিয়ায় নিয়োজিত বিভিন্ন এনজিওর প্রতিনিধিরাও অতিথি বক্তা হিসেবে ক্লাস নেন। ওই ক্লাসগুলোয় ধর্ষণ সংক্রান্ত শারীরিক ও সামাজিক বিষয়, চিকিৎসা ব্যবস্থা, এ সংক্রান্ত ধর্মীয়, আইনগত ও অন্যান্য বিষয়ের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ পাঠদান করা হয়। কোর্স শেষে অংশগ্রহণকারীদের এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। টঘগওখ সেক্টর কমান্ডার, সেক্টর-বি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সার্টিফিকেট বিতরণ করেন। ওই অনুষ্ঠানে টঘগওখ-এর সিনিয়র জেন্ডার অ্যাডভাইজার গরংং ঈধৎড়ষব উড়ঁপবঃ ছাড়াও ওই এলাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘ, এনজিও এবং সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী কর্তৃক গৃহীত এ পদক্ষেপটি লাইবেরিয়ার জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয় এবং তারা দেশব্যাপী এ কার্যক্রমের বিস্তার ঘটাতে প্রবল আগ্রহ ব্যক্ত করেন। ২০০৩ সালে টঘগওখ-এর কার্যক্রম শুরুর পর হতে এ ধরনের সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কর্মসূচি এটাই প্রথম। বর্তমানে ইখণঈ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবক-যুবতীরা স্থানীয় জনগণকে ধর্ষণের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও এ সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমার আজ সত্যিই আশা জাগছে যে সেদিন আর দূরে নয়, যেদিন কঙ্গো, দাফুর বা লাইবেরিয়ায় আর ধর্ষণ নামক জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত হবে নাু মানবতার এই ঘৃণ্যতম অপমান রোধকল্পে আমাদের শান্তিরক্ষী ভাইদের এই ক্ষুদ্র ও মহতী উদ্যোগ সেদিনই সম্পূর্ণরূপে সার্থক হবে।
উন্নত শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের কারণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ দেশে-বিদেশে সমানভাবে প্রশংসিত। আদর্শ চরিত্র গঠনের জন্য সেনাবাহিনীতে চরিত্র গঠনমূলক (ঈযধৎধপঃবৎ ঞৎধরহরহম) প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে প্রত্যেকটি সেনাসদস্যকে আইন-শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য শিক্ষা দেওয়া হয়। এরূপ আদর্শিক শিক্ষায় শিক্ষিত আমাদের শান্তিরক্ষীরা লাইবেরিয়ার সমাজ হতে ধর্ষণের মতো অনৈতিক ও ঘৃণিত এ কর্মকাণ্ডকে চিরতরে উৎখাত করতে যে মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেন তা টঘগওখ, বিভিন্ন এনজিও, লাইবেরিয়ার সরকার তথা লাইবেরিয়ার আপামর জনসাধারণের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। উলেল্গখ্য, শান্তিরক্ষী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বদাই ব্যক্তিগত শৃঙ্খলার বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে থাকে।

মেজর মোঃ লুৎফর রহমান, পিএসসি :লাইবেরিয়ার বাঙ্গায় কর্মরত শান্তিরক্ষী কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.