খাদ্য নিরাপত্তা-আলু প্রধান সহযোগী খাদ্য হয়ে উঠুক by অসিত মুকুটমণি

আলু চাষের পরিবর্তে কৃষক আবার তামাক চাষের দিকে ঝুঁকছে_ কিছুদিন আগে সমকালে প্রকাশিত এমন এক খবর উদ্বেগের। বাংলাদেশে অন্তত ১৬.৪০ কোটি মানুষের বাস। তথ্য বলে, এ দেশের মোট ৩৬৭ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে আবাদি জমি ১৯৩ লাখ হেক্টর, যা সমগ্রের ৫৩ শতাংশ। অবশিষ্ট ৪৭ শতাংশের মধ্যে ১৫-২০ শতাংশ পাহাড়িয়া,


৭-১০ শতাংশ জলাভূমি ও বাকি অংশে ঘরবাড়ি, কারখানা, রাস্তাঘাট, প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি অবস্থিত। অপরিকল্পিতভাবে নানাবিধ নির্মাণের কারণে প্রতিবছর ৮২ হাজার হেক্টর বা ১ শতাংশ আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে। তথ্য দৃষ্টে বসতাদি নির্মাণে গত ২০ বছরেই কৃষিজমি প্রায় ৫০ লাখ একর কমে গেছে, যা প্রতিদিন গড়ে ২২০ হেক্টর। উত্তরাধিকার আইনে জমি ও পরিবার বিভাজনের ফলে দেয়াল ও আইলে নষ্ট জমির পরিমাণ এত বেশি হচ্ছে যে, এ বিষয়ে এখন থেকেই প্রতিকারী পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন। বর্তমান জনবৃদ্ধির হার বিবেচনায় বছরে ২০ লাখ মানুষ বাড়লে (বর্ধনের মাত্রা কমানো না গেলে), ২০৫০ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ২২-২৫ কোটি হতে পারে, যা দেশের অগ্রগতি ও খাদ্য নিরাপত্তা ভাবনায় গুরুত্ববহ।
বাঙালির মূল খাদ্য ভাত, তবে সময়ের পরিবর্তনে ও চাহিদার তাগিদে ইতিমধ্যেই প্রধান সহযোগী খাদ্য হিসেবে গম স্থান দখল করে নিয়েছে এবং ভুট্টা ও আলু চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ভাত প্রধান খাদ্য হলেও খাবার তালিকায় বিভিন্নমুখী খাদ্য সংযোজনের ফলে ভাতের ব্যবহার জনপ্রতি এত কমে এসেছে যে, অনেক দেশই চাল রফতানি করছে। কিন্তু বাংলাদেশের খাদ্য সংস্কৃতিতে ভুট্টা, আলু, শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ প্রভৃতি তেমনভাবে সংযোজিত হয়নি বা হওয়ার মতো অনেকের ইচ্ছা বা সামর্থ্যও নেই। ফলে চালের ওপর চাপ ও চাহিদার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশ্ববাজার এবং দেশে মূল্য বেড়েছে। খাদ্য বলতে পরিমাণমতো শর্করা, আমিষ, স্নেহ, ভিটামিন, খনিজ, পানি ও আঁশ বিবেচ্য হয়। ধনী-গরিব নির্বিশেষে দু'একবেলা আটাও খেয়ে থাকেন, যদিও আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে তা অজনপ্রিয় ছিল এবং গরিবের খাদ্য হিসেবেই বিবেচিত হতো। ডাক্তাররা আটা খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বলেও খাদ্য তালিকায় আটা দ্রুত উঠে আসছে। তবে কৃষিযোগ্য জমি ও ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমা, জলস্তর নিচে নেমে যাওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন, অনিয়মিত ও অপরিমিত বৃষ্টিপাত, ঝড়, শিলাবৃষ্টি, বন্যা, হঠাৎ বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা, উৎপাদনের উপকরণগুলোর মূল্যবৃদ্ধি, কৃষিজমিতে বাগান করা, জমির শ্রেণী পরিবর্তনে আইনগত বাধা না নামা, সরু ধানের চাষ বেড়ে যাওয়া, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়াসহ নানাবিধ সমস্যা ধান উৎপাদনের দুটি মৌসুমে যে প্রভাব ফেলেছে এবং জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে ভবিষ্যতে চাহিদার সঙ্গে ধান, গম ও ভুট্টার উৎপাদন বৃদ্ধির সামঞ্জস্যতার বিষয়টি যেমন চিন্তায় ফেলেছে, তেমনি মূল খাদ্যের চাহিদা পূরণে আলুর ভূমিকা নানা কারণে সামনে এসে যাচ্ছে। স্থান, সময় ও জাতভেদে আলুর উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা, যেখানে ধানের ১২ থেকে ১৬.৫০, আর গমের প্রায় ১৪ টাকা। আবার পুষ্টিমানের বিবেচনায় আলুতে ভাতের চেয়ে শর্করা অনেক কম, প্রোটিন সমান প্রায় ৪ শতাংশ হলেও, খনিজ পদার্থ ও ভিটামিনাদি অনেক বেশি বলে আলুর পুষ্টিমান বেশি; কিন্তু ক্যালরির পরিমাণ কম। বাংলাদেশের প্রায় সব আবাদি জমিতে ধান চাষ হলেও ২০০৯-১০ সালে আলু চাষে জমির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১.৭৪ লাখ হেক্টর, যা ২০১০-১১ সালে বাড়িয়ে ৪.৮০ লাখ হেক্টর ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৮৪ লাখ মেট্রিক টন ধার্য করা হয় এবং তা অর্জিত হয়েছে। বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার ১০টি ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় আলু চাষ সম্প্রসারিত হলেও মূলত হেমন্তকালে শুকিয়ে যায় বাংলাদেশের এমন প্রায় সব শ্রেণীর জমিতে আলুর চাষ করা সম্ভব। কিন্তু সে হিসেবে ধান চাষের জমির পরিমাণ সেভাবে বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনেকখানি সীমিত, যদিও একফসলিকে দু'ফসলি বা তিন ফসলি করে এবং সেচ এলাকা বাড়িয়ে ধান চাষের এলাকা বাড়ানো যেতে পারে। সম্পূর্ণরূপে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বনে সব ফসলের উৎপাদনও বাড়ানো যায়। অন্যদিকে আলু উৎপাদনের জমির পরিমাণ এখনও এত বৃদ্ধি করা যায় যে আগামীতে ৩/৩.৫০ কোটি মেট্রিক টন পর্যন্ত উৎপাদনও সম্ভব। অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুনে মাত্র ৩ মাস আলু, গম ও ভুট্টা চাষ হয়, আর ধান চাষ হয় শ্রাবণ থেকে কার্তিক ও ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত। ফলে আলু, গম ও ভুট্টা চাষ ধান চাষের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। আবার আলুর জমিতে ধান চাষের খরচ কম লাগে; কিন্তু গম ও ভুট্টার জমিতে নয়। আলুর সামগ্রিক উৎপাদনের পরিমাণ যত বেশি হয় উৎপাদন খরচ ততই কমে আসে, যে সুবিধা ধান ও গমে কম। শীতকালে জলবায়ু অনেকখানি সুস্থির থাকে এবং পানি সেচ (৩ বার) যথেষ্ট কম লাগে ও নিশ্চিত থাকে বিধায় বীজ, সার ও কীটনাশকে কোনো ত্রুটি না থাকলে আলুর অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু ধান চাষের সময় বন্যা, হঠাৎ বন্যা, খরা, ঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, উপরিস্থ পানিশূন্যতা, ভূ-অভ্যন্তরের জলস্তর নেমে যাওয়া, উৎপাদনে প্রচুর পানির প্রয়োজন হওয়া ও সেচের অসুবিধা ঘটা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা প্রভৃতি কারণে ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়ে থাকে। তাই সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় চালের পাশাপাশি মূল খাদ্য তালিকায় সহযোগী খাদ্য হিসেবে আলুকে বহুভাবে ব্যবহার করে চালের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বৃদ্ধিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখা ছাড়া আগামীতে দ্রুত বর্ধমান বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটানো যথেষ্টই কঠিন।
৪১টি দেশে মূল খাদ্য আলু, সহযোগী খাদ্য গম, ভুট্টা। আবার যে দেশে মূল খাদ্য গম সেখানে সহযোগী খাদ্য আলু, ভুট্টা প্রভৃতি। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে মূল খাদ্য ভাত হলেও বাংলাদেশ ছাড়া অন্য সব দেশেই মূল খাদ্য তালিকায় যুক্ত হয়েছে গম, ভুট্টা, আলু, শাক-সবজি, মাছ, মাংস প্রভৃতি। তাই তাদের মাথাপ্রতি চালের ব্যবহার আমাদের তুলনায় কম। বস্তুত এসব দেশ থেকেই অনেক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে আমাদের চাল আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশের অগ্রগতি ও খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যেই আলু, এই পুষ্টিকর খাদ্যটিকে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে সবাইকে নানাভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ভাতের সঙ্গে আলু খাওয়ার পরিমাণ বাড়াতে হবে। আলু কিনতে অপারগ পরিবারকে আলু দিয়ে সহযোগিতা করা যায়। এতে আলুচাষি ৩-৪ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে এবং তাদের আলু চাষ ছেড়ে তামাক চাষে যাওয়া থেকে বিরত রাখা যেতে পারে। হিমাগার স্থাপন বা সম্প্রসারণ কাজে ঋণ দেওয়া ও অল্পমূল্যে কৃষকের আলু সংরক্ষণ এবং সরকারি বা বেসরকারিভাবে আলু রফতানির পদক্ষেপ নিশ্চিত করা ও আলুভিত্তিক শিল্প-কারখানা স্থাপন প্রভৃতি বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। চা'কে সামাজিক পানীয় করতে ব্রিটিশ আমলে বিনামূল্যে মোড়ে মোড়ে চা বিতরণ করা হতো। আজ সেই চা বলতে গেলে, বিশ্বে সামাজিকভাবে সবচেয়ে বেশি প্রিয় পানীয়। বাংলাদেশে আলুকে মূল খাদ্য তালিকায় সহযোগী খাদ্য হিসেবে উন্নীত করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এটা করা গেলে খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্যে স্বদেশনির্ভরতা সৃষ্টি হবে, মাতৃভূমির অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক অগ্রগতি নিশ্চিত হবে।

অসিত মুকুটমণি : প্রাবন্ধিক
 

No comments

Powered by Blogger.