স্বদেশ প্রত্যাবর্তনন-রাজনীতিতে শেখ হাসিনা ফ্যাক্টর by সুভাষ সিংহ রায়

তারপরও শেখ হাসিনা ধৈর্য ধারণ করে একাগ্রচিত্তে দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। '৭৫-পরবর্তী বিধ্বস্ত একটি দলকে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছেন। কাজটি খুবই কঠিন ছিল এবং এর জন্য অসংখ্যবার তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে।


গোটা বিশ্বের কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকে এতবার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়নি


শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। টানা ৩০ বছর তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন গণতান্ত্রিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। এখন তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু খুব সহজে তা অর্জন করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর থেকেই তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে।
১৯৮১ সালের ১৭ মে সে সময়কার সরকারি মালিকানাধীন জাতীয় দৈনিক 'দৈনিক বাংলা'য় একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সংবাদটি ছিল, 'শেখ হাসিনা প্রতিরোধ কমিটি সংঘর্ষ এড়ানোর জন্যই কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে প্রতিরোধ মিছিল ও বিক্ষোভ দেখানো কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে।' বোধ করি এটা উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই, সে সময়কার সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় শেখ হাসিনার আগমন প্রতিরোধ কমিটি করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যার দেশে প্রত্যাবর্তনের সংবাদে গণসমুদ্রে প্রবল জোয়ারের পূর্বাভাস দেখা দিয়েছিল; অসম্ভব হয়ে উঠেছিল তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রতিরোধ করা। কিন্তু ১৯৮১ সালে গড়া সেই প্রতিরোধ কমিটির পৃষ্ঠপোষকরা আজও প্রতিটি মুহূর্তে শেখ হাসিনাকে প্রতিরোধ করতে চক্রান্ত করে যাচ্ছে। এরাই শেখ হাসিনার প্রাণনাশের ব্যর্থ চেষ্টা করেছে এবং এরাই ২১ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর যারা বিরোধিতা করতেন, তারা বুঝেশুনেই করতেন। এখনও যারা করেন, তারাও না বুঝে করেন না। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়ার অবস্থান মোটেই এক নয়। যারা এটা এক করে মানুষের সামনে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন, তারাও বিলক্ষণ জানেন, নিজেরাই ভুল কথা বলছেন। দেশে-বিদেশের একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী খালেদা জিয়াকে নেত্রী বানিয়েছে। যারা বিএনপির নেতা হিসেবে পরিচিত, তারা যেমন এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ছিলেন; আবার যারা প্রগতিশীল ঘরানার তারকা, তাদের কেউ কেউ এ প্রক্রিয়ায় ছিলেন। বাংলাদেশে সবসময় কিছু সুশীল আছেন, যারা কারণে-অকারণে আওয়ামী লীগ-বিরোধিতায় অবতীর্ণ হন। এরা নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করলেও ফৌজিতন্ত্রের বিশেষ পরামর্শক। কবিগুরুর সেই অসাধারণ উদ্ধৃতি এখানে যথার্থ :'আমরা ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না।' এদের মধ্যে কেউ কেউ মানুষের সামনে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। আবার অনেকেই নিজেদের আড়ালে রেখেছেন। এদের সহজে চেনা যায় না। আবার যারা শেখ হাসিনাকে সামনে রেখে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে চেয়েছেন, তাদের অনেকেই সবসময় তার পক্ষে থাকেননি। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে না এলে যারা রাজনীতিতে কোনো জায়গা পেতেন না, তারাও একসময় তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার সঙ্গে অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা ছিলেন, যাদের অনেকেই অল্প সময়ের মধ্যে তাকে ছেড়ে চলে যান। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের স্লোগান দিয়ে নতুন দলও খুলেছিলেন। নিজামী-খালেদা জিয়া-তারেক জিয়ার শাসন এ দেশের ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায়। ১/১১ শাসকরা এ সুযোগে অভূতপূর্ব এক শাসন চাপিয়ে দিতে পেরেছিল। আশ্চর্যজনকভাবে এ শাসকদের লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনা। যে সরকারের কারণে ১/১১; সেই দলের প্রধানকে গ্রেফতার না করে শেখ হাসিনাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। সেই সংকটাপন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের তারকা নেতাদের কেউ কেউ ইমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। সে সময় তারা শেখ হাসিনাকে ত্যাগ করে নিজেরা বেঁচে যেতে চেয়েছিলেন। এমনকি শেখ হাসিনা তার নাতনিকে দেখতে আমেরিকায় গেলে ১/১১ সরকার তাকে স্বদেশে ফিরতে বাধা দিতে চেয়েছিল। গোটা পৃথিবীর বিবেকবান মানুষ ও গণতান্ত্রিক সরকার শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছিল। গোটা পৃথিবীর প্রচারমাধ্যমও তখন বাংলাদেশের জননেত্রীকে সমর্থন জুগিয়েছিল।
হত্যা ও ষড়যন্ত্রের বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রথিত হয়েছিল জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। বলার অবকাশ নেই, বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী দখলদারি সরকার প্রগতির ধ্বজাধারী এই নেতাদের রাজনৈতিক অভিলাষে সমর্থন জুগিয়েছে। বিচারপতি সায়েম তার 'অঃ ইধহমনধনযধনড়হ : খধংঃ চযধংব' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, 'ঞযব ঢ়ড়ষরঃরপরধহং ধৎব ঁংবফ ঃড় মড় পধহঃড়হসবহঃ ভড়ৎ পড়হংঁষঃধঃরড়হং; ড়ভ পড়ঁৎংব অধিসর খবধমঁব ধিং হড়ঃ ঃযবৎব.'
প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ কখনোই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বুঝতে চায়নি। এখনকার দিনে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভুলে যান, জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমানবলে দেশ চালিয়েছেন। এমনকি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দখল করে নিয়েও তিনি বঙ্গবভবন থেকে সরকার পরিচালনা না করে ক্যান্টনমেন্টে বসে সরকার চালিয়েছেন। তিনি কখনও বঙ্গবভনে থাকেননি।
শেখ হাসিনাকে '৭৫-পরবর্তী শাসকরা বারবার হত্যা করতে চেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে একজন অসম্ভব ধার্মিক মানুষ শেখ হাসিনা সবসময় বিশ্বাস করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের 'গীতাঞ্জলি' কাব্যগ্রন্থের তিনটি লাইনে। 'বিপদে মোরে রক্ষা করো/এ নহে মোর প্রার্থনা/বিপদে আমি না যেন করি ভয়।' সেই শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ একটি অসাধারণ কবিতা (পথে পথে পাথর) লিখেছেন। কবিতার কয়েকটি লাইন হচ্ছে_
শেখ হাসিনা, আপনার বেদনা আমি জানি;/ আপনার প্রত্যাবর্তন আজও শেষ হয়নি/বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে/আপনি পা রেখেছেন মাত্র/আপনার পথে পথে পাথর ছড়ানো/পাড়ি দিতে হবে দুর্গম গিরি/কান্তার মরুপথ।
৩০ বছরের সাফল্যময় রাজনীতির ঋদ্ধতার পরিপূর্ণতায় এখনকার শেখ হাসিনা। সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু, সব রাজনৈতিক আন্দোলন, তৎপরতা, প্রশংসা-নিন্দার লক্ষ্য ও উপলক্ষ। এটাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাম দেওয়া যেতে পারে_ 'শেখ হাসিনা ফ্যাক্টর। শেখ হাসিনা দেশে না এলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ব্রাকেটবন্দি হয়ে পড়ত। কোনো স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হতো না, সংসদীয় রাজনীতির কথা কেউ হয়তো বলত না। শেখ হাসিনা এ দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির পবসবহঃরহম নড়হফ-এর মতো কাজ করেছেন।'
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সর্বপ্রথম ২০ মে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার সংবর্ধনার আয়োজনা করা হয়েছিল। সেই সংবর্ধনা সভায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, '...আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতির দূরে থেকে আমি ঘর-সংসার করছিলাম। আপনাদের ডাকে সবকিছু ছেড়ে এসেছি। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার এ জীবন দান করতে চাই।' শেখ হাসিনা তার কথা রেখেছেন। দু'দু'বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তিনবার বিরোধী দলের নেত্রী হয়েছেন। আজকের সংসদীয় রাজনীতি শেখ হাসিনার দীর্ঘ সংগ্রামের সোনালি ফসল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা ও তাদের সুফল ভোগকারীরা ভেবেছিল, আওয়ামী লীগ আর এ দেশে দাঁড়াতে পারবে না। অহরহ বলা হতো, আওয়ামী লীগ একদিন মুসলিম লীগ হয়ে যাবে। ফৌজিতন্ত্রের নানা প্রলোভনে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাও বিভ্রান্ত হয়েছিলেন এবং দলে নানা সময়ে নানাভাবে বিভক্তি তোলার চেষ্টা করেছিল। তারপরও শেখ হাসিনা ধৈর্য ধারণ করে একাগ্রচিত্তে দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। '৭৫-পরবর্তী বিধ্বস্ত একটি দলকে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছেন। কাজটি খুবই কঠিন ছিল এবং এর জন্য অসংখ্যবার তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। গোটা বিশ্বের কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকে এতবার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়নি।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে সর্বশেষ নির্বাচন পর্যন্ত দেখা যায়, আওয়ামী লীগ প্রতিটি নির্বাচনে আগের নির্বাচনের চেয়ে ভালো ফল করেছে। এটা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। সংকটের আবর্তে নিমজ্জমান অবস্থা থেকে দেশ পুনরুদ্ধার করে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, সুখী ও সুন্দর জীবন গড়ে তোলাই তার একমাত্র ব্রত। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সুখী, সমৃদ্ধশালী ও কল্যাণরাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম করছেন। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে না এলে বাংলাদেশকে কেউ একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখাতে পারতেন না। শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগিয়ে তুলে দিনবদলের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন।

সুভাষ সিংহ রায় : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
suvassingho@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.