পদ্মা সেতু সরকারের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ by ইফতেখারুজ্জামান

পদ্মা সেতু নিয়ে এ পর্যন্ত যা ঘটে গেল তার মধ্য দিয়ে সব কিছুর যে সমাপ্তি ঘটল, তা কিন্তু নয়। বরং আরেকটি নতুন অধ্যায় শুরু হলো। বিশেষ করে আমাদের সরকারের সামনে এখন একটি অগি্নপরীক্ষা। প্রথমে যখন বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে, সরকারের পক্ষ থেকে তা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।


কিন্তু অভিযোগকারী বিশ্বব্যাংক ছিল প্রথম থেকেই শক্ত ভূমিকায় দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে। এর মধ্যে সরকার অন্যান্য সূত্র থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণের তহবিল জোগাড়ের কথাবার্তাও চালিয়ে যায়; বিশেষ করে মালয়েশিয়ার সঙ্গে। অন্যদিকে দুদকের তদন্তও চলতে থাকে। এভাবে উভয়পক্ষের গড়িমসি বা অবস্থানগত অস্পষ্টতার কারণে কেবল কালক্ষেপণ হতেই থাকে। তদন্তেরও কোনো কিনারা হয়নি। বিশ্বব্যাংকও তাদের সঠিক অবস্থান বা তাদের পরবর্তী সিদ্ধান্তের কথা স্পষ্ট করেনি। এ অবস্থা চলাকালেই, অনেকটা হুট করে বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়াল, যা কারো কাম্য নয়। কারণ সরকারের গাফিলতি বা উদাসীনতার কারণে দেশের মানুষের ভোগান্তি হতে পারে না। আবার বিশ্বব্যাংকের মতো একটি পুরনো বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানেরও কোনো সিদ্ধান্তের কারণে জনসাধারণের ক্ষতি হোক তা মেনে নেওয়া কষ্টকর। সরকার ও বিশ্বব্যাংক একসঙ্গে বসে যা কিছুই করার চুক্তি করুক, প্রকল্প নিয়ে ভাবুক- সে তো দেশের সাধারণ মানুষের উন্নয়নের কথা ভেবেই। রাষ্ট্রও একটি সংস্থা, বিশ্বব্যাংকও। তাদের এমন কোনো সিদ্ধান্তই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, যাতে একটি দেশের জনগণ বঞ্চিত হয়। কারণ চুক্তি, কাজ- সেতু বা যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণ, সবই জনগণের স্বার্থে এবং তা হবে জনগণের অর্থে। সুদ-আসলে জনগণকেই সব ঋণ পরিশোধ করতে হয়।
ঘুষের আদান-প্রদানই শুধু দুর্নীতি নয়, ক্ষমতার অপব্যবহারও দুর্নীতি। এ সব কিছু হিসেবে নিয়ে আমাদের সরকারের এখন উচিত নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করে বিশ্বব্যাংক, দেশবাসী ও বিশ্বকেও দেখাতে হবে। এ শুধু এখনকার মতো একটি তাৎক্ষণিক ঘটনা নয়। বিশ্বব্যাংক যে কলঙ্ক লেপন করে পিঠ দেখাল, তা মোচন করার ভার আমাদের, সরকারের। ভবিষ্যতের জন্য কালিমামুক্ত হওয়া সবচেয়ে জরুরি। তাই সরকারের উচিত হবে দুদকের ওপর ভরসা না করে এখন একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা। যে কমিটির ওপর সবার আস্থা থাকবে। আর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এ বিষয়ে একেবারে যোগাযোগ বন্ধ না করে বরং সহজ সম্পর্ক বজায় রেখে তদন্তের প্রয়োজনে তাদের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। যদি দুর্নীতির দায়ে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা অভিযুক্ত বলে প্রমাণিত হয়, তবে সরকারের উচিত তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিজেদের অবস্থানকে স্বচ্ছ করা। বিশ্বব্যাংকও ইদানীং জবাবদিহি ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়েছে নতুন করে। কারণ বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেও অনিয়ম-অসংগতির অভিযোগ রয়েছে। যেসব দেশ বিশ্বব্যাংকে তহবিল জোগান দেয়, সেসব দেশ বিশ্বব্যাংকের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আর সে কারণেও হয়তো বিশ্বব্যাংকের আচরণ আগের চেয়ে অন্য রকম মনে হতে পারে।
তবু হঠাৎ করে পদ্মা সেতুর চুক্তি বাতিল করা অনেকটা মাথাব্যথা সারাতে মাথা কাটার মতো। বিশ্বব্যাংক বা সরকার কাউকে সে সুযোগ বা অধিকার কেউ দেয়নি, কিছু লোকের অন্যায়-অনিয়ম বা দুর্নীতির কারণে একটি জাতি উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হবে, আর দুর্নীতির বদনাম মাথায় নেবে। আমাদের সরকারকে এখন আরো বেশি কৌশলী হতে হবে। কারো প্রতি সহমর্মী না হয়ে কঠোর হতে হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। জাতির ললাটে যে কালিমা লেপন করা হলো, তা মোচনের দায়িত্ব যেমন সরকারের, পদ্মা সেতু নির্মাণের ভারও তাদেরই নিতে হবে। কেননা পদ্মা সেতু এখন সর্বোচ্চ আলোচিত একটি প্রকল্প। সরকার এখন একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলে সবার জন্য মঙ্গল।
অন্যান্য দাতা দেশ বা সংস্থা থেকে ফান্ড জোগাড় করে সেতু নির্মাণ করা আর বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে করা সম্পূর্ণ দুটো জিনিস বর্তমান পরিস্থিতিতে। তা ছাড়া অন্যান্য সূত্র থেকে তহবিল গঠন বা গ্রহণ করলে এর মূল্য পড়বে অনেক বেশি। এই বেশি ব্যয়ের বোঝা জনগণ বহন করবে কেন, সরকারই বা এ বাড়তি ভার বইবে কেন? দুর্নীতি যদি কেউ করে থাকে, শাস্তি তারই প্রাপ্য। আর যদি নিরপেক্ষ তদন্তে প্রমাণিত হয় যে দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা, তাহলে বিশ্বব্যাংককেও এই অপ্রিয় ঘটনাবলির দায় নিতে হবে।
(অনুলিখন)
লেখক : ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক

No comments

Powered by Blogger.