জলবায়ু পরিবর্তন-উন্নত বিশ্ব কার্যকর সাড়া দিক

মূলত শিল্প ও প্রযুক্তিগত যথেচ্ছাচারের কারণে সংঘটিত জলবায়ু পরিবর্তনের যে বিরূপ প্রভাবের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে, তা মোকাবেলায় গ্রিন টেকনোলজি বা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হতে পারে অন্যতম উপায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার ১৬তম কংগ্রেসে ভাষণ দিতে গিয়ে এ ব্যাপারে


যথার্থই গুরুত্ব আরোপ করেছেন। গ্রিন টেকনোলজির বিকাশে পর্যাপ্ত, স্থায়ী ও সহজলভ্য তহবিলের জোগান দেওয়ার জন্য তিনি শিল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছেন, সেটাও যথেষ্ট যৌক্তিক। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বনাশা বিপদ ডেকে আনার জন্য উন্নত বিশ্বের কর্মকাণ্ডই প্রধানত দায়ী। এর ফলে এমনিতেই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকা আরও জেরবার হয়ে যাবে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষায় এমন আশঙ্কা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও মরুকরণের ফলে বাংলাদেশে বন্যা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নিম্ন উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধির মতো বিপর্যয়কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও ঘনত্ব বাড়বে। হুমকির মুখে পড়বে খাদ্য, পানি ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশের ভারসাম্য এবং জীবনযাত্রার ধরন। এ প্রশ্ন এখন খুবই সঙ্গত যে, উন্নত বিশ্বের কর্মকাণ্ডের কুফল আমরা ভোগ করব কেন? আমরা মনে করি, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ যেসব দুর্যোগ ও দুর্ভোগের শিকার হবে, তার দায় উন্নত বিশ্বকেই নিতে হবে। এটা ঠিক যে, দৈত্যকায় এই প্রাকৃতিক পরিবর্তনের জন্য কোন দেশ কতখানি দায়ী সেটার চুলচেরা বিশ্লেষণ সম্ভব নয় এবং এই বিপদ মোকাবেলায় বিলম্বে হলেও গোটা বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখা জরুরি, বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত অথচ নানা বিবেচনায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশের জন্য উন্নত বিশ্বের সহযোগিতা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা কঠিন। কিন্তু সেক্ষেত্রে গত তিন বছরে যা হয়েছে, তা আমাদের জন্য হতাশারই জন্ম দেয়। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিস্তর কথাবার্তা সত্ত্বেও কোপেনহেগেন ও কানকুন সম্মেলনে কার্যকর অগ্রগতি সম্ভব হয়নি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত যে, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের এ বছর ডিসেম্বরে ডারবানে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে কার্যকর কিছু করার সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না। উন্নত বিশ্বের এ-ও মনে রাখা জরুরি যে, সামষ্টিক বিপদ মোকাবেলায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষে যা করণীয়, সেক্ষেত্রে ঘাটতির অভিযোগ নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের পক্ষে নীতিগত ও ব্যবহারিক প্রস্তুতি সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তার দেশ ১৩৪ দফা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা না থাকলেও কেবল নৈতিক দায়িত্ব থেকে গৃহীত বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্মসূচি স্বল্পোন্নত অনেক দেশের জন্য অনুসরণীয় হয়েছে। বৈদেশিক সাহায্যের অপেক্ষায় না থেকে বাংলাদেশ যে ১৪শ' কোটি টাকার নিজস্ব তহবিল গঠন করেছে, তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের পক্ষে তা-ও কম শ্লাঘার নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিরূপ প্রভাবের শিকার স্বল্পোন্নত অন্যান্য দেশও এই বিপদ মোকাবেলায় বৈশ্বিক জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এখন আসলে উন্নত বিশ্বেরই দায়িত্ব হচ্ছে দ্রুততম ও কার্যকর সাড়া দেওয়া। আমরা আশা করি, জেনেভায় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পর সেক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখা যাবে।

No comments

Powered by Blogger.