দুদকের সংবাদ সম্মেলন-আবুল হোসেনের ব্যাংক হিসাব জব্দের পরামর্শ দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক

সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট (ভ্রমণবৃত্তান্ত পেতে) জব্দের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে অনুরোধ করেছিল বিশ্বব্যাংক। এই সঙ্গে মন্ত্রীর পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভ্রমণবৃত্তান্ত সংগ্রহ ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করার পরামর্শ দেয় তারা।


গতকাল রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান এসব তথ্য জানান। লিখিত বক্তব্যে দুদক জানায়, দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত, অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদের সময় নিজেদের প্রতিনিধি উপস্থিত রাখারও দাবি করে বিশ্বব্যাংক। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দুদক আইনে এটা সম্ভব ছিল না।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়ে বিশ্বব্যাংককে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার কথা জানায় দুদক। তাদের প্রতিটি অভিযোগই গুরুত্বের সঙ্গে অনুসন্ধান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংক আনসেটিসফেক্টরি রেসপন্সের (সন্তোষজনক উদ্যোগ) যে অভিযোগে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করেছে, তা সঠিক বলে মনে করি না।’ কমিশনের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের যে আলোচনা হয়েছে, তারপর এ ধরনের সিদ্ধান্ত ‘অযৌক্তিক, অনভিপ্রেত ও অন্যায্য’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ বিষয়ে দুদক বিশ্বব্যাংকের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদপত্র পাঠাবে।
বর্তমানে পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। বিশ্বব্যাংক দুদককে এ-সংক্রান্ত কিছু তথ্য ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের নাম সরবরাহ করেছে। এ অবস্থায় ঋণচুক্তি বাতিল করাকে সঠিক বলে মনে করে না দুদক।
দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক গত শুক্রবার পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিলের ঘোষণা দেয়। ২৯০ কোটি মার্কিন ডলারের এ প্রকল্পে তাদের ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ছিল।
কমিশনের চেয়ারম্যান জানান, বিশ্বব্যাংক গত বছর এ প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করলে কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্তের উদ্যোগ নেয়। এক দফা তদন্তের পর গত ফেব্রুয়ারিতে দুদক সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল, মূল সেতু নির্মাণে প্রাকযোগ্য প্রতিষ্ঠান (ঠিকাদার) নির্বাচনে কোনো দুর্নীতি হয়নি। তবে পরামর্শক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত এখনো চলছে। এটা অব্যাহত থাকবে বলে দাবি করেন গোলাম রহমান। তিনি বলেন, ‘আইনের পরিধির মধ্য থেকে দুদক দুর্নীতির অভিযোগ বিশ্বস্ততার সঙ্গে অনুসন্ধান করে যাবে।’
গতকাল দুদকের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহার নোট বইয়ে ‘পারসেন্টেজ টু বি অ্যালোটেড টু স্পেসিফাইড পারসনস ইস কানেকশন উইথ দি অ্যাওয়ার্ড অব দি সিএসসি কনট্রাক্ট’ এবং কিছু নাম সাংকেতিকভাবে লেখা ছিল। তার আলোকে বিশ্বব্যাংক একটি সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করে। এ তালিকাসহ কিছু তথ্য বিশ্বব্যাংক অর্থমন্ত্রীর হাতে এবং কমিশনের কাছে পৌঁছে দেয়।
বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ: সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত দুদকের আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক দুদকের তদন্তে কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি। বরং দুদকের তদন্তে হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিল।’
গত ২৩-২৫ জুনে বাংলাদেশে সফরে আসা চার সদস্যের বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধির সঙ্গে একাধিক বৈঠকের বরাত দিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা কিছু অবাস্তব দাবি জানায়। যেমন, সন্দেহজনক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় উপস্থিত থাকা, সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব তলব, পাসপোর্ট জব্দ ইত্যাদি। এগুলোর কোনোটাই দুদক আইনে সিদ্ধ নয়।’ বিশ্বব্যাংকের এসব দাবি মেনে নিলে দুদককে আদালতের মুখোমুখি হতে হতো বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ওই প্রতিনিধিদলে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক পরিচালক অ্যালেন গোল্ডস্টেইন, পরিচালক জ্যাক স্টেইন, ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সির পরিচালক জেমারমেইন ও একজন আইন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। প্রতিনিধিদের কাছে উপযুক্ত দালিলিক প্রমাণসহ তথ্য চাওয়া হলে তাঁরা নতুন করে কোনো ধরনের তথ্য দিতে অপারগতা জানান বলে অভিযোগ করেন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান।
এ সময় আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক দাবি করেন, ‘পদ্মা সেতু অর্থায়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করতেই বোধ হয় বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা ওই দুই দিনের সফর পরিকল্পনা করেছিল।’
দুদকের সীমাবদ্ধতা: সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদকের আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক জানান, বিশ্বব্যাংক দুদকের অনুসন্ধান টিমের সঙ্গে তাদের একটি প্যানেল গঠনের প্রস্তাব দেয়। যে প্যানেল দুদকের অনুসন্ধানে যুক্ত থেকে তদন্ত পর্যবেক্ষণ করবে। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের সময় বিশ্বব্যাংকের প্যানেলের সদস্যরাও উপস্থিত থাকবেন। তিনি বলেন, ‘২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইন অনুযায়ী এর কোনো সুযোগ নেই।’
এ সময় দুদক কমিশনার মো. সাহাবউদ্দিন বলেন, ‘আমরা আমাদের আইনের মধ্যে থেকে বিশ্বব্যাংককে সার্বিক সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি।’
কানাডা পুলিশ তথ্য দেবে না: কানাডীয় রয়েল মাউন্টেড পুলিশের কোনো সদস্য বাংলাদেশে আসেননি জানিয়ে দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘কানাডীয় তদন্ত সংস্থার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ হয়েছিল। তবে তাদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশির কথিত দুর্নীতিতে জড়িত থাকার তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি। ওখানকার তদন্ত দল বাংলাদেশকে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত দেবে না বলেও জানিয়েছে।’ দুদকের চেয়ারম্যান দাবি করেন, তথ্য না দেওয়ার যুক্তি হিসেবে কানাডা পুলিশ বলেছে, ‘বাংলাদেশে কোনো কিছু গোপন থাকে না।’

No comments

Powered by Blogger.