আমাদের সংবিধান ও চট্টগ্রাম ট্র্যাজেডি by শহিদুল ইসলাম

এক. চট্টগ্রামের বিয়োগান্ত পাহাড়ধসে মানুষের মৃত্যুতে প্রতিবছরের মতো এবারও এ দেশের মানুষ শোকাহত। যে কারণে প্রতিবছর পাহাড়ে ধস নামে এবং মানুষ মরে, প্রতিবছরের মতো এবারও তার বিচার-বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। বিভিন্নজন তার মতো করে এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করছেন। আমার প্রথমেই প্রশ্ন- এটা কি প্রাকৃতিক বিপর্যয়?


ভূমিকম্প, সুনামির মতো? এর কারণ সবার জানা। এটা যে প্রাকৃতিক ট্র্যাজেডি নয়- এ দেশের শক্তিধর ধনিক শ্রেণীর লোভের শিকার চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো এ নিয়ে প্রতিবছর প্রচুর লেখালেখি হয়। এরপর সব থেমে যায়, আগামী বছর পাহাড়ধস পর্যন্ত। এ বছরের ২৮ জুন সমকালের ৯ পৃষ্ঠা থেকে বেশ বড় একটি রিপোর্টের অংশ উদ্ধৃত করি। রিপোর্টটির নাম 'যে কারণে একের পর এক পাহাড়ধস'। চট্টগ্রাম ব্যুরো থেকে কাজী আবুল মনসুর লিখেছেন, 'পাহাড় কেটেই বানানো হয়েছে চট্টগ্রামের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা খুলশী। আর এই খুলশীকে কেন্দ্র করেই পাহাড়ধসের সৃষ্টি।' গত ৩০ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ১২০টি পাহাড়। পাঁচ বছরে বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে পাঁচ শরও বেশি লোকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা শতাধিক। বৃহত্তর চট্টগ্রামের ১৩ হাজার ২৯৫ বর্গমাইলজুড়ে থাকা পাহাড়ি এলাকা ক্রমে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। নগরীতে পাহাড় কেটে আবাসিক ভবন, পার্বত্য এলাকাগুলোয় প্রভাবশালীদের বাগান বিলাস, পাহাড়িদের জুম চাষে পাহাড় ন্যাড়া হয়ে যাওয়ার কারণে মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটছে। স্থপতি জেরিনা হোসেন বলেছেন, 'মানুষের লোভ অত্যধিক বেড়ে গেছে। পাহাড় কেটে কেটে বড় ডেভেলপার কম্পানিগুলো ১৫ থেকে ২০ তলা ভবন তৈরি করছে।' মোটামুটি এ কারণ প্রতিবছর খবরের কাগজগুলোতে প্রতিধ্বনিত হয়। আল্লাহ বড়লোকদের সহায় থাকলে আগামী বছরও একই কথার প্রতিধ্বনি হবে। বছর তিন-চার আগে কক্সবাজারে গিয়ে একই কথা শুনেছিলাম সেখানকার দরিদ্র লোকদের মুখে। আরো শুনেছিলাম, পাহাড় দখলের বিরুদ্ধে নাকি হাইকোর্টে মামলাও চলছে। সে মামলার অগ্রগতি জানি না। তবে ওই মামলার ভবিষ্যৎও অজানা নয়। কারণ পাহাড় দখলকারীরা এ দেশের ধনিক শ্রেণী। তাঁরা সরকারে আছেন, বিরোধী দলে আছেন, বুদ্ধিজীবী শিক্ষকদের মধ্যে আছেন, আইনপাড়ায় অ্যাডভোকেটদের মধ্যে আছেন, আছেন এনজিও, মানবাধিকার সংস্থার মধ্যে এবং আছেন সাংবাদিকদের মধ্যেও। তাঁরাই এ দেশের আইনের মালিক, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক, তাঁরাই টেলিভিশন-সংবাদপত্রের মালিক, তাঁরাই সুপার মার্কেটের মালিক, তাঁরাই গার্মেন্ট কারখানার মালিক এবং তাঁরাই যাতায়াত ব্যবস্থার মালিক। কাজেই পাহাড়ধসে প্রতিবছর যারা মারা যায়, তাদের সাধ্য কী না মরে? যারা মারা যায়, তাদের জন্মই হয়েছে এভাবে মরার জন্য। এমনই আইন রচনা করে গিয়েছিলেন নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লবের পর। সে আইনই আজ পৃথিবী শাসন করছে।
দুই. এটা পুঁজিবাদের অবশ্যম্ভাবী ফসল। অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের গুরু মিলটন ফ্রিডম্যান আমাদের শিখিয়ে গেছেন কিভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে পুঁজিবাদের সম্প্রসারণে ব্যবহার করা যায়। আইনের মারপ্যাঁচে যা দখল করা যায় না, প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগিয়ে তা কিভাবে দখল করে পুঁজিবাদ তার অনেক উদাহরণের উল্লেখ করেছেন নোয়ামি ক্লিন তাঁর বিখ্যাত 'শক ডকট্রিন' বইটিতে। পুঁজিবাদের মূলনীতি সব সময় মানবিক ট্র্যাজেডির জন্য অপেক্ষা করায়। কিন্তু চট্টগ্রামের প্রতিবছরের ভূমিধস প্রাকৃতিক কোনো ট্র্যাজেডি নয়, এটা মনুষ্যসৃষ্ট। ধনিক শ্রেণীর প্রচণ্ড লোভের কাছে প্রতিবছর মাত্র কয়েকজন মানুষকে জীবন দিতে হয়। আর দখল করা পুঁজিবাদের একটি মূলস্তম্ভ যেটা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে গেছেন ফরাসি বিপ্লবের পর নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তাই ১৮১৫ সালে পরাজিত হলেও আমরা আজ নেপোলিয়নের কাছে ঋণী। তিনি মধ্য বুর্জোয়া শ্রেণীর জন্য যে সংবিধান রচনা করে গেছেন, তা আজও আমাদের কাছে পবিত্র আমানত। বলা যায়, নেপোলিয়ন কর্তৃক রচিত সংবিধানই আজ বিভিন্ন দেশে একটু এদিক-সেদিক করে গৃহীত হয়েছে। সেই সংবিধানে 'দখল' সংবিধান সম্মত। অবশ্য সব দেশেই দু-চারটা ভালো কথার আড়ালে তা ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে।
তিন. 'সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার' মহান স্লোগান মুখে নিয়ে আঠারো শতকের শেষে ফ্রান্সে যে 'ফরাসি বিপ্লব' সাধিত হয়, তার প্রতিপক্ষ ছিল তিনটি শ্রেণী। এক. অভিজাত রাজা ও জমিদার শ্রেণী, দুই. নবোদিত শ্রমিক ও ভূমিহীন কৃষক শ্রেণী এবং তিন. এদের মাঝে নবোদিত বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণী। নানা ঘটনায় সমৃদ্ধ বিপ্লবের শেষ পর্বে নেপোলিয়নের উত্থান ও তাঁর দ্বারা রচিত আইনকানুনের মাধ্যমে বুর্জোয়া মধ্য শ্রেণীর জয় সুনিশ্চিত হয়। মধ্য শ্রেণী সমগ্র পৃথিবীকে শাসনের স্বপ্ন দেখে। তাদের সে স্বপ্ন সফল হয়েছে। নেপোলিয়ন যেসব সংস্কার করেছিলেন, সেগুলোর অন্যতম হলো পুরুষদের সর্বজনীন ভোটাধিকার, সব জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, জমিদারদের সব সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহার, গির্জার অধিকার খণ্ডন ইত্যাদি। ১৮১০ সালের 'নেপোলিয়ন কোডে' তিনি আইনের চোখে সব নাগরিকের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠা করেন। অতীতের সব বৈষম্যমূলক সুবিধাদি ও ঐতিহ্য বাতিল করেন। তাঁর সবচেয়ে মহান কীর্তি হলো তিনি সম্পত্তির অধিকারকে এক মহান অধিকার বলে স্বীকৃতি দেন, যা ছিল উঠতি মধ্য শ্রেণীর প্রাণের দাবি। তাঁর সব সংস্কার ছিল মধ্য বুর্জোয়া শ্রেণীর পক্ষে। তিনি মেধাকে সর্বোচ্চ স্থান দেন। জন্মসূত্রে নয়, মেধার শক্তিতে সাধারণ ঘরের মানুষও সমাজের উঁচু স্থানে পেঁৗছাতে পারেন। এভাবে তিনি পুঁজিবাদের পক্ষে এক প্রস্থ আইন রচনা করেছিলেন, যা আজও আমাদের মতো দেশের মানুষের কাছে কাম্য। আমরা ওই সব আইনের সফল বাস্তবায়নের জন্য লড়াই করছি। সেগুলোর একটু ব্যত্যয় ঘটলে আমরা চিৎকার করি- 'গণতন্ত্র গেল।' তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, সেই পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত না হলে আজ ৭০০ কোটি মানুষের ভাত-কাপড় জুটত না। আবার এ কথাও সত্য, সেই পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদ মাত্র এক শতাংশ মানুষের হাতে জমত না- ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এভারেস্ট স্পর্শ করতে পারত না। সেদিনের সেই দুর্বল মধ্য শ্রেণীই আজ পৃথিবীর মালিক। রাজা-বাদশাহ-জমিদারের আভিজাত্য তার পেছনে নেই এ কথা ঠিক; কিন্তু তার ক্ষতি করার ক্ষমতা আজ হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই প্রমাণ চট্টগ্রামের প্রতিবছরের পাহাড়ধস। পুরো বাংলাদেশটা আজ ওই পাহাড়খেকো দানবের দখলে।
চার. আমাদের সংবিধান নেপোলিয়নের সংবিধানের প্রতিরূপ। নেপোলিয়ন সম্পত্তির অধিকারকে আসমানি পর্যায়ের মহান অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আমাদের সংবিধানের (৪২) ধারায় সম্পত্তির অধিকারকে এক মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। বলা হয়েছে, 'প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর ও অন্যভাবে বিলি ব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে।' কিন্তু এ অধিকার যে অবাধ ও বাধাবন্ধনহীন, সে কথাটি 'আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে' বাক্যাংশের দ্বারা গোপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। তা ছাড়া আরো বলা হয়েছে, 'আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাইবে না।' চট্টগ্রামের পর্বতখেকোদের সবাই চেনে। কিন্তু সমকালের চট্টগ্রাম ব্যুরো থেকে ফিরোজ শিবলী জানান, 'তাই এবারও পার পেয়ে যাচ্ছে পাহাড়খেকোরা।' (২৯ জুন ১২) শিবলী জানাচ্ছেন, 'চট্টগ্রামে প্রাণহানির ঘটনায় ৯ অপমৃত্যুর মামলায় নেই পাহাড়খেকোদের নাম।' শিবলী লিখেছেন, 'চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামি নেই পাহাড়খেকো রাঘব বোয়ালরা। বনায়নের জন্য বরাদ্দ নিয়ে পাহাড়ে অবৈধভাবে ঘর তুলে ভাড়া দিলেও সেই পাহাড়খেকোদের আসামি করা হয়নি। মঙ্গলবার পাহাড় ধসে ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটলেও পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো মামলা করা হয়নি।' দেশবাসী প্রশ্ন করতে পারে- 'কেন'? উত্তরে বলতে হয় 'ছিঃ, তারা দেশের বরেণ্য ধনিক শ্রেণী।' বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সম্পত্তির অধিকার তাদের সাংবিধানিক অধিকার। 'বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে' তারা পাহাড় কেন গোটা দেশও যদি গিলে খায়, তাহলেও কি তাদের নামে মামলা করা সমীচীন? ছিঃ! এ দেশেরই নয় শুধু, পৃথিবীর সব পুঁজিবাদী দেশে 'আইনের কর্তৃত্ব' ও 'বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে'র প্রয়োগকারী তাঁরাই- ওইসব পাহাড়খেকো। তাই এ কথা স্পষ্টই বলে দেওয়া যায়, যত দিন দেশের সর্বোচ্চ আইনের বই 'সংবিধানে' সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত থাকবে, তত দিন ক্ষমতাবান ধনিক শ্রেণী পাহাড় খাবে, গুলশান লেক-বুড়িগঙ্গা খাবে, গার্মেন্ট শ্রমিকদের শ্রম নিংড়ে খেয়ে তাদের আখের ছোবড়া বানিয়ে ছাড়বে। এ দেশের জনগণের তেল-গ্যাস-কয়লা খাবে, মানুষ খাবে, প্রতিদিন-প্রতি মুহূর্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে, বিনা বিচারে মানুষ খুন করবে ইত্যাদি। 'আইনের কর্তৃত্বে'র কোন ক্ষমতা আছে, তাদের চুল স্পর্শ করে? এমন একজন ধনিক শ্রেণীর 'মহান' মানুষের নাম করুন তো, যিনি বিচারের রায় ঘাড়ে নিয়ে জেলে রয়েছেন? এ দেশের সংবিধানে সমাবেশের স্বাধীনতা 'সুরক্ষিত' আছে, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একটা মৌলিক অধিকার। কিন্তু সব কিছুর আগে চারটি 'শব্দ-বন্ধন' আছে, যা ওইসব মৌলিক অধিকারকে সোনার পাথর বাটিতে পরিণত করেছে। তাহলে- 'যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে।' এভাবে বুর্জোয়া গণতন্ত্র এক হাতে দেয়- অন্য হাত দিয়ে তা কেড়ে নেয়। তাই পুঁজিবাদ ও বুর্জোয়া গণতন্ত্র মানুষের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে একটি নতুন প্যারাডাইস হিসেবে পুঁজিবাদ পৃথিবীকে এগিয়ে দিয়েছিল। আজ সমগ্র পৃথিবী আর একটি নতুন প্যারাডাইসের অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ।
২৯ জুন, ২০১২

No comments

Powered by Blogger.