ভবদহ-জোয়ারাধার বন্ধ মানে জলাবদ্ধতা by ইকবাল কবির জাহিদ ও অনিল বিশ্বাস

নতুন করে ভবদহে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা যশোরবাসীকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। একটি অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে বিল কপালিয়ার জোয়ারাধার প্রকল্প বন্ধ হতে বসেছে। যশোরবাসীর জন্য এ এক অশনিসংকেত। অন্যদের মতো কপালিয়ার জনগণও বোঝে, জোয়ারাধার ছাড়া এলাকা বাঁচানোর আর কোনো উপায় নেই।


এটা বাতিল হলে হরি-শ্রী নদী পলিভরাট হবে এবং পানি নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ হবে; এলাকা আগের মতো আবারও জলমগ্ন হয়ে পড়বে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনুমান, কপালিয়ার জোয়ারাধার প্রকল্প বন্ধের একটি ষড়যন্ত্র চলছে। জনমত প্রস্তুত না করেই জোয়ারাধার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জাতীয় সংসদের মাননীয় হুইপ আবদুল ওহাবসহ জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা ও নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে বহু মানুষ আহত হয়েছে; সরকারি গাড়ি, দোকানপাট ও কৃষকের ঘরবাড়ি পুড়েছে। এরপর পাঁচ সহস্রাধিক অজ্ঞাতনামা নারী-পুরুষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তালগোল পাকিয়ে উঠছে। দশ লক্ষাধিক মানুষের ভাগ্য এখন অনিশ্চিত।
জনগণের দীর্ঘ আন্দোলনের চাপেই ভবদহে টেকা, শ্রী-হরি নদী সংস্কার, বিল খুকশিয়ায় জোয়ারাধার বাস্তবায়ন ও জনগণের নিজস্ব উদ্যোগে আমডাঙ্গার খাল খনন হওয়ায় ভবদহে ২০ বছরের জলাবদ্ধতার অবসান ও জনজীবনে স্বস্তি ফিরে এসেছিল। সেই স্বস্তি উবে যাওয়ার আশঙ্কায় মানুষের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
বিল খুকশিয়ায় টিআরএম চলছে সাত বছর। বিলে সাত ফুটের মতো ভূমি উঁচু হয়েছে। বেড়েছে হরি-শ্রী নদীর গভীরতা। পরবর্তী টিআরএমের উপযুক্ত স্থান বিল কপালিয়া। এখানে কাজ শুরুর দিনই সংঘর্ষ ও বিপর্যয়ের সংকেত। টিআরএম বন্ধ হলেই নদী ভরাট হয়ে যাবে, পানি নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ হয়ে গোটা এলাকা ডুবে যাবে।
জোয়ারাধার কী: জোয়ারাধার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের শত বছরের পুরোনো একটি নিজস্ব উদ্ভাবন। অতীতে কৃষকেরা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাঁধ দিয়ে লোনাপানি ঠেকিয়ে আবাদ করতেন এবং আবাদ শেষে বাঁধ কেটে জোয়ারে পলি তুলে বিল উঁচু করে নিতেন। এর নামই অষ্টমাসি বাঁধ। মাঘী পূর্ণিমায় বাঁধ দিয়ে আষাঢ়ে খুলে দেওয়া হতো। এভাবে একই সঙ্গে চলত চাষাবাদ আর ভূমি-গঠনের কাজ। ১৯৫৪ সালে ক্রুগমিশনের পরামর্শে এ পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়। সেই থেকে নদীর তীর বরাবর সমান্তরাল বাঁধ ও স্লুইসগেট দিয়ে স্থায়ী কর্ডন-পদ্ধতি চালু হয়। এতে বিলে লোনাপানি ওঠা বন্ধ হলো; পলি ওঠাও থেমে গেল। কিন্তু পলিতে নদী ভরাট হয়েছে। ভেঙে পড়ে নিষ্কাশনব্যবস্থা। এ অঞ্চলে প্রতিবছর মাটির অবনমন ঘটে প্রায় তিন ইঞ্চি। আগে এলাকায় বছরে ছয় থেকে নয় ইঞ্চি পলি জমত। ভূমি উঁচু হতো। তাই ফি-বছর গড়ে চার-সাড়ে চার ইঞ্চি পলি জমত। ক্রুগমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নে ভূমি-গঠনের সেই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া থেমে যায়। একদিকে ভূমির অবনমন, বিপরীতে নদীবক্ষে পলিভরাট। পরিণতিতে ১৯৭৫ সাল থেকেই এলাকা জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে। এখন বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বাড়তি উপসর্গ যুক্ত হয়ে বিপদ আরও ঘনীভূত হয়েছে।
বিগত শতকের আশির দশকে বিল ডাকাতিয়ার কৃষকেরা সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাঁধ কেটে পলি উঠিয়ে তিন দশকের জলাবদ্ধতার অবসান ঘটিয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ভরতভায়নার কৃষকেরা একইভাবে তাঁদেরও মাঠ উঁচু করে নেন।
১৯৯৮ সালে যশোর জেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক সভায় বিভিন্ন কৃষক সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতারা প্রাচীন অষ্টমাসি পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব করেন। ড. আইনুন নিশাত, ড. স্বপন আদনান, ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল্লাহসহ বিশিষ্টজন সভায় আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। তাঁদের পরামর্শে জোয়ারাধার স্বীকৃতি পায়। গণদাবিতে সরকার প্রস্তাবটি মেনে নেয় এবং পরে তা টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) বা জোয়ারাধার নামে পরিচিতি পায়। মানুষ দেখেছে, জোয়ারাধারে নদীর গভীরতা বাড়ে; জলাবদ্ধতার নিরসন হয়। তাই সবাই বুঝেছে, এ মুহূর্তে এর কোনো বিকল্প নেই।
সংঘর্ষের কারণ: একশ্রেণীর ঘেরমালিক ও কায়েমি চক্র জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তারা অল্প টাকার হারিতে কৃষকের জমিতে ঘের করেছে। তাদের শঙ্কা, জোয়ারাধার চালু থাকলে বিল উঁচু হবে, ঘের হবে না। কপালিয়ায় দুই-আড়াই শ বিঘা খাস ও অর্পিত সম্পত্তি আছে, যা এখন ঘেরমালিকদের কব্জায়। টিআরএম হলে এই জমি তাঁদের হাতছাড়া হবে।
ইতিপূর্বে খুকশিয়ার কৃষকদের ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে ভোগান্তি হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ঢিলেমিপনা এর জন্য দায়ী। টিআরএম-বিরোধীরা এই দুর্বলতাকে প্রচারের কাজে লাগাচ্ছেন। ইতিমধ্যে আবার তাঁরা কপালিয়ার কৃষকদের টাকা দেওয়া বন্ধ করেছেন। জমির মালিকেরা এসে ফিরে যাচ্ছেন।
যশোর-৫ ও ৬ আসনের সাংসদদ্বয়, পাউবো ও জেলা প্রশাসন জনগণকে আস্থায় আনার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়নি। আছে সরকারি দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব। এসব তালগোলে যে চক্র কায়েমি স্বার্থে অতীতে টিআরএমের বিরোধিতা করত, তারাও ফায়দা লুটছে। জনগণের কাছে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
বর্তমানে টিআরএমের বিরোধিতা করছে মাত্র তিন গ্রামের মুষ্টিমেয় মানুষ, যেখানে জমির পরিমাণ মাত্র এক হাজার বিঘা। জোয়ারাধার ব্যর্থ হলে ডুববে কপালিয়াসহ ভবদহ এলাকার এক লাখ ১৬ হাজার হেক্টর আবাদি জমিসহ যশোর শহরের দক্ষিণে বিল হরিণা অবধি। বিল হরিণার দৈর্ঘ্য পাঁচ কিলোমিটার ও প্রস্থ তিন কিলোমিটার। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষ।
এখন করণীয়: যেকোনো পরিস্থিতিতে টিআরএম অব্যাহত রাখা জরুরি। তার জন্য দ্রুত জনগণকে আস্থায় আনতে হবে। ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটিসহ সব আন্দোলনের সংস্থা, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সমন্বয়ে জনমত গঠন ও মনিটরিং সেল গড়ে তুলতে হবে।
বর্ষা শুরু হয়েছে। কপালিয়ায় এ মুহূর্তে টিআরএমের কাজের সুযোগ নেই। তাই খুকশিয়ায় আরও এক বছর টিআরএম চালু রাখতে হবে। তার জন্য সহজ শর্তে বকেয়া পরিশোধসহ নতুন বছরের জন্য বিল কপালিয়ার সমহারে ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে হবে। কাগজপত্রের জটিলতা এড়িয়ে হাল রেকর্ডে মাঠপর্চার ভিত্তিতে টাকা দেওয়াই যুক্তিযুক্ত।
এলাকার খেতমজুরদের ভিজিএফ কার্ডের আওতায় আনাসহ বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করা সংগত। ভবদহ গেটের পাশে বাঁধ কেটে সরাসরি হরি-শ্রী নদী সংযোগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনো অবস্থায়ই আর গেটের সংকীর্ণ ছিদ্র দিয়ে জোয়ারের পানি তোলা ঠিক হবে না। এতে পানির গতি শ্লথ থাকে, যা টিআরএমের জন্য ক্ষতিকর। বিল কপালিয়ার খাসজমি ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে টিআরএম-পদ্ধতিতে ভূমি উঁচু করতে প্রায় ৩০০ বছর লেগে যাবে। তাই স্থায়ী সমাধানের জন্য মাথাভাঙ্গা-পদ্মার সঙ্গে সংযোগ দিয়ে কপোতাক্ষ-ভৈরব-মুক্তেশ্বরীসহ পর্যায়ক্রমে নদীগুলো খনন করা যুক্তিসংগত।
ইকবাল কবির জাহিদ, প্রধান উপদেষ্টা: ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি।
অনিল বিশ্বাস, আহ্বায়ক: কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন।

No comments

Powered by Blogger.