পদ্মা সেতু নির্মাণ-বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন কি এতই জরুরি by ম. ইনামুল হক

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন কি এতই জরুরি? যমুনা সেতু নির্মাণের সময় আমরা বিদেশি ঋণের দিকে না তাকিয়ে জনগণের টাকায় নিজস্ব অর্থায়নেই কাজ শুরু করেছি। পরে এসেছে অন্যান্য লগি্নকারী সংস্থা। আমরা তিস্তা ব্যারাজ নিজস্ব অর্থায়নে করেছি। পদ্মা সেতুর বেলাতেও কি আমরা একই কাজ করতে পারি না?


বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদ যমুনা নামে ২২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা নদীতে মিশেছে। এর পর এই মিলিত স্রোত ১০৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিশেছে। চাঁদপুর থেকে ভাটির মেঘনাতে বঙ্গোপসাগরের দূরত্ব নদীপথে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। যমুনা, পদ্মা ও মেঘনার এই নদীপ্রবাহের কারণে বাংলাদেশ পূর্ব-পশ্চিম দুটি ভাগে বিভক্ত। এর পূর্ব অংশ দিয়ে মেঘনা প্রবাহিত হলেও ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ভৈরববাজারের রেল সেতু এখনও ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ শহরগুলোর যোগসূত্র রক্ষা করে। বাংলাদেশের পশ্চিম অংশে গঙ্গা নদীর প্রবাহ থাকলেও ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হার্ডিঞ্জ রেল সেতু রংপুর, রাজশাহী, বগুড়ার সঙ্গে যশোর, খুলনা, ফরিদপুরের যোগসূত্র রক্ষা করছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮০-এর দশকে শুরু হয়ে '৯০-এর দশকে শেষ হওয়া যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই সেতু বাংলাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম অংশকে সড়ক ও রেলপথে যুক্ত করে দিয়েছে। যমুনা সেতুর নির্মাণ শুরু হয় এরশাদ সরকারের আমলে। যমুনা সেতু নিয়ে আমরা তেমন কোনো ঝামেলায় পড়িনি। বরং স্বপ্ন দেখেছি ও স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। পদ্মার ওপরেও একটি সেতু নির্মাণের স্বপ্ন আমরা দেখেছি। কিন্তু তাতে এসেছে অনেক ঝামেলা।
শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম মেয়াদে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল গঙ্গার পানি চুক্তি ও পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি চুক্তি। খালেদা জিয়ার সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিকে (জাইকা) পদ্মা সেতু নির্মাণের সমীক্ষা কাজে নিয়োগ করে। জাইকা পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ, দোহার-চরভদ্রাসন, মাওয়া-জাজিরা এবং চাঁদপুর-ভেদরগঞ্জ এই ৪টি সাইটে তাদের সমীক্ষা চালায়। জাইকা ২০০৪ সালে দেওয়া প্রি-ফিজিবিলিটি রিপোর্টে বলে, সেতু নির্মাণের জন্য পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ এবং মাওয়া-জাজিরা সাইট দুটি গ্রহণযোগ্য। তবে মাওয়া-জাজিরা সাইটটিই (সাইট-৩) অধিক গ্রহণযোগ্য। তখনকার বিএনপি সরকার জাইকা প্রতিবেদন গ্রহণ করে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্থান ঘোষণা করে। সরকারি সিদ্ধান্তের পরপরই পদ্মা সেতু নির্মাণের স্থান নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। সরকার তখন ঘোষণা দেয় দৌলতদিয়া এবং মাওয়া উভয় স্থানেই সেতু নির্মাণ করা হবে। এর পর কোন স্থানে সেতু নির্মাণ আগে হবে, বা একটি হলে আরেকটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিনা_ এ নিয়ে সংশয় এবং উভয় পক্ষের সমর্থনকারী জনগণের আন্দোলন চলতে থাকে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে_ যেখানে ২২০ কিলোমিটার যমুনা নদীতে একটি সেতুই যথেষ্ট, সেখানে ১০৪ কিলোমিটার পদ্মা নদীতে কেন দুটি সেতু নির্মাণ করা হবে? বিদেশি ঋণের বোঝা নিরীহ জনগণের ওপর চাপিয়ে পদ্মা নদীতে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরত্বে দুটি সেতু নির্মাণের এই মহাপরিকল্পনা কার স্বার্থে করা হচ্ছে? পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারও এই বিতর্কের মধ্যে পড়ে। তবে তারা মাওয়াতে সেতু নির্মাণ কাজে এগিয়ে যায়।
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে জাইকা তার সমীক্ষা রিপোর্টে ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার মাওয়া সেতু নির্মাণে ৮ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকার (১২০ কোটি ডলার) সম্ভাব্য ব্যয়ের প্রাক্কলন দিয়েছিল। আমাদের দৃষ্টিতে এই সাইটটির দক্ষিণ অংশ গঙ্গা নদীর পূর্ব খাত এবং অত্যন্ত ভাঙনপ্রবণ বিধায় ভুল ছিল। দৈনিক প্রথম আলো জানায় (২০-০১-২০১০), একনেক ২০০৭ সালে মাওয়া সেতুর জন্য ১৪৭ দশমিক ২৭ কোটি ডলারের প্রকল্প অনুমোদন করে; যদিও তখনও ভূতাত্তি্বক জরিপ হয়নি, নদীশাসনের জন্য মাটি পরীক্ষার ফলাফলও হাতে আসেনি, কিন্তু সেতু নির্মাণের সম্ভাব্য খরচ বেড়ে যায়। শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে বলে, খরচ হবে ১৮০ কোটি ডলার, যা পরে দাঁড়ায় ২৬০ কোটি ডলারে। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০ অক্টোবর ২০১০ বলেন, ২০১১ সালের মার্চ মাসে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে এবং এ জন্য ব্যয় হবে ২৯০ কোটি ডলার বা ২০ হাজার ৩শ' কোটি টাকা। সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বলেন, সেতুর নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির কারণ এর দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার করা হয়েছে (প্রথম আলো ২১.১০.২০১০)। আমরা অনেক আগেই এই ভুল সাইটটি পরিবর্তন করার জন্য ৫ মে ২০০৯ প্রেস ব্রিফিং এবং ১৫ মে ২০০৯ মানববন্ধন করি, এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিই। ২৬ জুন ২০০৯ বিস্তারিত জানিয়ে এর পরামর্শকদের পত্র দিই। এর পর আবার ৬ অক্টোবর ২০০৯ এবং ২৬ অক্টোবর ২০১০ প্রেস ব্রিফিং ও মুক্ত আলোচনার আয়োজন করি।
জাইকার প্রতিবেদনে যে সুপারিশ ছিল, তা অবশ্যই ভুল ছিল। কারণ, পদ্মা নদীর ঐতিহাসিক গতি পরিবর্তন মাওয়া-জাজিরা সাইটকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। উল্লেখ্য, পদ্মা নদীর পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ এবং মাওয়া-জাজিরা উভয় সাইটের উত্তর তীর প্রায় একই রকম শক্ত কাদামাটির হলেও দক্ষিণ তীর অস্থিতিশীল। দক্ষিণের গোয়ালন্দ পাড়ের মাটি কাদামিশ্রিত পলির, আর জাজিরা পাড়ের মাটি শুধুই বালির। এর কারণ এই স্থানে আড়িয়াল খাঁ নদের গতিপথের ওপর দিয়ে ১৫০ বছর আগেও গঙ্গা নদী প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ত। তাই এখানে জাজিরা ও শিবচর এলাকায় পদ্মার দক্ষিণ তীর সব সময় ভাঙনকবলিত থাকে। জাইকা মূল প্রতিবেদনে সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার ও পরে ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার বললেও শেষমেশ ১০ কিলোমিটারে গিয়ে দাঁড়ায়। এই দৈর্ঘ্যও স্থিতিশীল হতে পারে না। জাইকা মূল প্রতিবেদনে এখানে ৬ কিলোমিটার পাড় প্রতিরক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পদ্মার অতীত গতিপথের কারণে সেতুর পাড় থেকে পিঁয়াজখালী পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার নদীশাসনের প্রয়োজন হবে। এর ফলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় ৩০ হাজার কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। শুধু নির্মাণ ব্যয় নয়; মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে দুটি সেতু নির্মাণের কোনোই যুক্তি নেই।
বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি প্রস্তাবিত মাওয়াতে সেতুর দক্ষিণে চর জানাজাতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য সম্ভাব্য সাইট হিসেবে সমীক্ষা চালায়। এই সমীক্ষায় দেখা গেছে (ডেইলি স্টার ৫.১১.২০১১) স্থানটি ভাঙনপ্রবণ। সমীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস ১০ কিলোমিটার উজানে দোহারের চর বিলাসপুরের ভাঙনমুক্ত অঞ্চলে ওই বিমানবন্দর নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা এরই পশ্চিম পাশে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করে আসছি। জাইকা স্টাডিতে সেতুর এই সাইটটি সবচেয়ে কম ব্যয়সাধ্য হলেও তদবিরের চাপে বিবেচনা-বহির্ভূত হয়ে যায়। আমরা বলছি, মাওয়া ও দৌলতদিয়া পয়েন্ট দুটির পরিবর্তে মাঝামাঝি দূরত্বে দোহার-চরভদ্রাসন পয়েন্টে ১টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করলে সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ট্রাফিক একই সেতু দিয়ে ঢাকা যেতে-আসতে পারবে। ফলে বর্তমান সেতু তথা একটি অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ সেতু নির্মাণ বাবদ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। দোহার-চরভদ্রাসন পয়েন্টের উত্তর তীরে ধুলসরায় শক্ত মাটির পাড় ও দক্ষিণে চরভদ্রাসনের হাজীগঞ্জে পাড় প্রতিরক্ষা কাজ আছে। এর ফলে পাড় প্রতিরক্ষা ব্যয়ও কম হবে। পদ্মা নদীর এখানে ঘড়ফধষ চড়রহঃ থাকায় সেতুর দৈর্ঘ্য সর্বাধিক ৭ কি.মি. এবং সর্বমোট ব্যয় ১২ হাজার কোটি টাকা হবে। তাছাড়া ঢাকার হেমায়েতপুর ও ফরিদপুরের তালমা থেকে নতুন রেল ও সংযোগ সড়কের খরচও কম পড়বে। আমরা বারবার আওয়ামী লীগ সরকারকে পদ্মা সেতু নির্মাণ বিষয়ে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে বলেছি। আমরা পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রেল ও সড়ক যোগাযোগের আমূল পরিবর্তন দেখতে চেয়েছি।
আওয়ামী লীগ আমলে পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয় যখন দফায় দফায় বেড়ে যাচ্ছিল, তখনই এক পর্যায়ে এর প্রধান অর্থলগি্নকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ আনে। বিশ্বব্যাংক অতঃপর সেপ্টেম্বর ২০১১ ও এপ্রিল ২০১২ বাংলাদেশ সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে তাদের অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণাদি দাখিল করে। বিগত ৩০ জুন ২০১২ এক পত্রের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক পূর্বাপর উল্লেখ করে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে অর্থলগি্নর প্রস্তাব তুলে নিয়েছে। আমি বলব, এতে শাপেবর হয়েছে। দুর্নীতি যদি হয়েই থাকে, তাহলে সত্য উদ্ঘাটন করা হোক এবং আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তি দেওয়া হোক। আর বলব, আসুন পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা নতুন করে ভাবি। আমরা কেন একটির জায়গায় দুটি সেতু নির্মাণ করতে যাচ্ছি? কেন জনগণের ওপর অহেতুক অতিরিক্ত ঋণের বোঝা চাপাতে চাচ্ছি? আমি দেশবাসী এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে দোহার-চরভদ্রাসন সাইটে সেতু নির্মাণ বিষয়টি বিবেচনা করতে ও এগিয়ে আসতে বলব।
আর বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন কি এতই জরুরি? যমুনা সেতু নির্মাণের সময় আমরা বিদেশি ঋণের দিকে না তাকিয়ে জনগণের টাকায় নিজস্ব অর্থায়নেই কাজ শুরু করেছি। পরে এসেছে অন্যান্য লগি্নকারী সংস্থা। আমরা তিস্তা ব্যারাজ নিজস্ব অর্থায়নে করেছি। পদ্মা সেতুর বেলাতেও কি আমরা একই কাজ করতে পারি না?

প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক :সাবেক মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ও কলাম লেখক
minamul@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.