বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-মন্দ উত্তরাধিকার

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিল : সাধারণ নির্বাচন ঘনিয়ে এলে দলীয় সরকার যেসব অন্যায় বা পাপ করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থীদের স্বার্থ রক্ষিত হতে পারে এমন প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার প্রদান।


কিন্তু চলতি বছরটি নির্বাচনী বছর নয়। সবকিছু ঠিকঠাক চললে বর্তমান সরকার আরও তিনটি বাজেট ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারবে। এ কারণে রাজনৈতিক বিবেচনায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে তেমন জোরালো তাগিদ থাকার কথা নয়। এর পরিবর্তে বরং বিচক্ষণতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকল্প সম্পন্ন করার কাজে মনোনিবেশ প্রত্যাশিত। এভাবে চললে আখেরে লাভ হওয়ার কথা। কিন্তু সোমবার সমকালে 'শেষ মুহূর্তে এডিপি বাস্তবায়নের হিড়িক :কাজের গুণগত মান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না' শিরোনামের প্রতিবেদনে স্পষ্ট যে, সরকার সেই একই গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা মন্দ উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি। বছরের প্রথম আট মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির জন্য বরাদ্দ অর্থের মাত্র ৩৭ শতাংশ ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু পরের দুই মাসে আরও ২৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়ে গেছে। অর্থাৎ আট মাসে ব্যয় হয়েছে ৬০ শতাংশ অর্থ। বাকি দুই মাসে ৪০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে কি-না সে প্রশ্ন করা যায়। গত দুই মাসের মতো 'উল্কার বেগে কাজ' চললে আরও ২৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হলেও ১৭ শতাংশ অর্থ অব্যবহৃত থেকে যাওয়ার কথা। আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার রাজস্ব বাজেটের তুলনায় অনেক ছোট। অথচ উন্নয়ন খাতে বরাদ্দের তাগিদ সীমাহীন। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে যিনিই থাকেন, শোনা যায় একটি বাক্য :'চারদিকে এত বরাদ্দের দাবি মেটাব কী করে?' তারপরও প্রতি বছরই দেখা যায়, উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ অর্থের পুরোটা ব্যয় করা যায় না। কিন্তু যেটুকু ব্যয় করা হয় তার মানও কি অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ থাকে না? তাড়াহুড়োর ব্যয়ে সর্বদাই অনিয়ম ও অপচয়ের সুযোগ থাকে। এ ছাড়াও রয়েছে সরকারি উন্নয়ন ব্যয়ে ভাগ বসানোর জন্য অনেকের নজর। প্রতিদিনের সংবাদপত্রে সরকারি কাজের টেন্ডার পেতে সংঘাত-হানাহানির যে খবর থাকে তার অন্যতম উৎস এই উন্নয়ন কর্মসূচি। সরকার ই-টেন্ডারের কথা বলছে। তা কার্যকর করা গেলে প্রকাশ্যে শোডাউন হয়তো কিছুটা কমবে, কিন্তু কাজের মান বাড়বে, এমন নিশ্চয়তা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো শুধু বরাদ্দ অর্থের চেক তুলেই বাস্তবায়ন কাজ দেখিয়ে দেয়। এভাবে গুণগত ও মানসম্পন্ন কাজ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তার এ মন্তব্য অভিজ্ঞতাপ্রসূত। বর্তমান সরকার কি এ থেকে নিজের করণীয় নির্ধারণ করতে পারবে? অভিজ্ঞতা বলে, এ কাজ কঠিন। একদিকে প্রকল্পের বাস্তবায়নে সরকারের সচিবালয় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত দক্ষতা বাড়ানোর প্রতি যথাযথ মনোযোগ এখনও দৃশ্যমান নয়, অন্যদিকে সরকারি কাজ থেকে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ে বিপুল তৎপরতা_ এ ট্রাডিশন ভাঙবে কে?
 

No comments

Powered by Blogger.